বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি আর বজ্রকঠিন চরিত্রের কল্পকথাগুলি একটু একটু করে ধুলো হয়ে উবে যাচ্ছে অনেকদিন হল। এখন তর্কটা এসে দাঁড়িয়েছে তিনি আদৌ এদেশের – দেশের মানুষের – জন্য শুভ কিছু, কল্যাণকর কিছু করে – বা অন্তত শুরু করে – যেতে পেরেছিলেন কি? নাকি স্রেফ ব্রিটিশ প্রভুদের ইশারায়, অঙ্গুলিহেলনেই বাঁধা ছিল তাঁর কার্যপরম্পরা? ঘুলিয়ে ওঠা কাদাজল সামান্য স্বচ্ছ করার প্রচেষ্টায় অশোক মুখোপাধ্যায়। এটি চতুর্থ পর্ব। প্রথম , দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব ক্রমান্বয়ে এখান থেকে পড়া যাবে – লিংক এক, দুই ও তিন।
[৭]
মাইকেল মধুসূদন দত্তকে অনেকেই বিদ্যাসাগরের ভাবশিষ্য বলে মনে করেন। বস্তুত মধুকবিই সম্ভবত সমকালের একমাত্র সাহিত্যিক যিনি বিদ্যাসাগরকে সম্পূর্ণ বুঝেছিলেন। তাঁর কবিতায় তার খানিকটা আঁচ পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে মধুসূদনের সম্পর্ক নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তার সবই সত্য না হলেও কিছু যে সত্যি তা অনুমান করা সম্ভব। বাংলার নবজাগরণের সেই উত্তাল পর্বে, যখন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র হয়ে যুক্তিবাদী ধারাটি অনেক সম্ভাবনা নিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল, শীঘ্রই যার সাথে একে একে যুক্ত হবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রোকেয়া সাখাওয়াত, মুকুন্দ দাস, কাজী নজরুল ইসলাম ও অন্যান্য নাম, প্রায় সেই সময়ের সমান্তরালে ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, প্রমুখ এসে এক প্রবল বিপ্রস্রোতের জন্ম দিলেন। যেখান থেকে আবার এক পুনরুত্থানবাদী হিন্দু ভক্তিবাদী ধারার সূত্রপাত হল। অতীত মন্থন, অতীতের গৌরব কীর্তন বা পৌরাণিক চরিত্রের পূজন যার অন্যতম প্রধান লক্ষণ। গর্ব বোধের জন্য যে শুধুই পেছনের দিকে তাকাতে বলে। যে কেবলই পিছু হাঁটার পথ খুঁজে বেড়ায়।
এই দুটো ধারার মধ্যে পার্থক্যটা মৌলিক। পার্থক্যটা বুঝতে পারলেও বাংলার রেনেশাঁসের অধ্যায়টাকে খানিকটা অন্তত চেনা যায়। ভক্তিবাদী ধারার প্রাধান্যের ফলে ভারতীয় সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে এর পরিণাম হয়েছে ধ্বংসাত্মক। বিদ্যাসাগরীয় ধারার মধ্যে একটা অন্য সম্ভাবনার ইঙ্গিত যে লুকিয়ে ছিল তা বোঝা যায়। অবশ্য বুঝতে চাইলে।
বোঝার অনুপান হিসাবেই আর এক দিক থেকে বিষয়টিকে এখানে উত্থাপন করব। সেই সময়ের বুকে একটি গদ্য সাহিত্য আর একটি মহাকাব্য যেন সেই ভক্তিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে শব্দোত্তর প্রতিবাদের আকারে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এক নম্বর “সীতার বনবাস” এবং দ্বিতীয়টি হল “মেঘনাদবধ কাব্য”।
লক্ষণীয়, দুটি সৃষ্টিই বেছে নিয়েছিল নায়ক বা নায়িকা হিসাবে প্রচলিত পুরাণ কাহিনির দুটি পার্শ্বচরিত্র। দুই সাহিত্য কর্মই প্রধান চরিত্র হিসাবে বাদ দিয়েছিল রামচন্দ্রকে। একটিতে উঠে আসেন মহাকাব্যের উপেক্ষিতা নায়িকা সীতা দেবী। আর একটিতে বীর্য শৌর্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন রাবণ আর ইন্দ্রজিত। এ কি নিছকই আপতিক? নাকি, এর পেছনে দুই স্রষ্টার কোনো বিশেষ সম মনোভাবনা ক্রিয়াশীল ছিল?
ভারতের ধ্রুপদী সামন্ততন্ত্রের যুগে নানা শাখা প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে রামায়ণ এবং মহাভারতের সৃষ্টি ও নানা পর্বে বিকাশ হয়েছিল। দুটি মহাকাব্যই সুদূর প্রাচীন কালে গাথা কাব্য হিসাবে জন্ম নিলেও গুপ্ত যুগের সমকালে এরা ব্রাহ্মণ্যধর্ম বা সনাতন ধর্ম প্রচারের হাতিয়ারে পর্যবসিত হয়। ভক্তির মাদকরসে আপামর শূদ্র তথা নিপীড়িত জনসাধারণকে এবং নারী সমাজকে আপ্লুত করে সামন্তী শোষণ ও জুলুমবাজিকে ভুলিয়ে দেওয়ার এক সুন্দর আয়োজন করা হয়েছিল এই মহাকাব্যের মাধ্যমে। রাম এবং কৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতারত্ব প্রদান করে তাদের জনগ্রাহ্যতা অনেকখানি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যাতে তাদের চরিত্র-রূপের মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণীয় পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলি জনমানসে চারিয়ে দেওয়া যায়।
সামন্তযুগে ব্যক্তি ছিল রাজা ও ঈশ্বরের স্বেচ্ছাধীন। অন্য দিকে এর বিপরীতে রেনেশাঁসের অন্যতম লক্ষণ আমরা দেখেছি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রকাশ ও জয়গান; নারী স্বাধীনতার চিন্তা; নরনারীর সমান সামাজিক ভূমিকা ও অধিকারের আদর্শ। মানুষের পরিচয় দৈব ক্রীড়নক হিসাবে নয়, স্বকীয় শক্তিতে। সব দেশে সব কালে সমান ভাবে না হলেও বিভিন্ন মাত্রায় এর একটা সর্বজনীন অভিব্যক্তি ও উত্থান দেখা গেছে।
আশ্চর্যের কিছু নেই, বিদ্যাসাগর এবং তাঁরই চিন্তায় অনুপ্রাণিত মধুসূদন এই সমস্ত রেনেশাঁস্ত অনুপান ভারতের সংস্কৃতিতেও প্রচলন করতে চাইবেন। ফলে দৈবানুগৃহীত রামচন্দ্র বা কৃষ্ণ নয়, নির্যাতীতা, মিথ্যা কলঙ্কের দায়ে নিগৃহীতা, সীতার যন্ত্রণাই তাঁকে বেশি ভাবাবে এবং কাঁদাবে। তাই পুরাণের থেকে যে কাহিনিটি তিনি তাঁর ছাত্রদের কাছে পরিবেশনার বেছে নিলেন, তা এতকালের ভাবনাধারণার থেকে আলাদা হয়ে গেল। বঙ্কিম চন্দ্র রসিকতা বা ব্যঙ্গ করে এই রচনাটিকে “কান্নার জোলাপ” আখ্যা দিলেও আপন অজ্ঞাতসারে তিনি সত্যি কথাটা বলে ফেলেছেন। বিদ্যাসাগর পুরুষ শাসিত সামন্তী শাসনে ভারতীয় নারীর মর্ম বেদনায় নিজেও কেঁদেছেন, পাঠককেও কাঁদাতে চেয়েছেন।
যে রাবণ ছিল পৌরাণিক মহাকাব্যের খলনায়ক, সে এবং তার পুত্র মেঘনাদ হয়ে উঠল মধুসূদনের নতুন কথাকাব্যের নায়ক। কী বীর্যে, শৌর্যে, কী যুদ্ধকৌশলে, কী অস্ত্র নিক্ষেপনে, কী চরিত্রের মাধুর্যে! রামচন্দ্র এবং লক্ষণ হয়ে উঠল তাদের তুলনায় বেঁটে ক্ষত্রিয়। যারা লুকিয়ে শত্রুকে বধ করে, ছলনার আশ্রয় নেয়। যাদের বিভীষণ লাগে। ভ্রাতৃঘাতী বেইমান সুগ্রীব দোসর হয়। বাপ রে! পশ্চিমে কুইসলিং আবিষ্কারের কতকাল আগে এই পুণ্যভূমি ভারতে বিভীষণের জন্ম হয়েছিল! {উত্তর-উপনিবেশিক চিন্তাবিদরা এই গর্বের দেশজ মূর্তিটি নিয়ে ভেবেছেন কিনা জানা যায় না!}
অবশ্য “রামের রাজ্যাভিষেক” নামে তাঁর একটি অসম্পূর্ণ ও জীবিতকালে অপ্রকাশিত রচনার সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু সেটি পাঠ করলেই বোঝা যায়, নিতান্ত গতানুগতিক লেখা, স্কুলে পাঠরত ছাত্রদের বাংলা ভাষা শিক্ষাদান ভিন্ন এর আর কোনো মতবাদিক বা আবেগিক মূল্য নেই।
বরং এবার আমরা একটি স্বল্প পরিচিত রচনার দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। “ব্রজবিলাস”। সংরক্ষণের অভাবে এর প্রথম সংস্করণ কবে প্রকাশিত হয়েছিল জানা যায় না। হয়ত ১৮৭৬ সাল। তবে দ্বিতীয় সংকরণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। লেখক হিসাবে বলা হয়েছিল “কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য প্রণীত”। ছদ্মনামে রচিত ও প্রকাশিত। এই বইটিতে তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তীর্যক গল্পচ্ছলে যে সমস্ত বাণ নিক্ষেপ করেছিলেন, তার কয়েকটা পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন! অন্তত আজকের দিনে। এমনকি এর একটা আধুনিক ভাষা সংস্করণ প্রকাশ করাও দেশের পক্ষে বর্তমান সময়ে মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদের হাতিয়ার হিসাবে সবিশেষ উপকারী হতে পারে।
প্রথমেই জেনে নিই, “ব্রজবিলাস” নাম কেন?
নবদ্বীপের একজন বিশিষ্ট নৈয়ায়িক ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন ভট্টাচার্য সেই সময় যশোরের এক সভায় বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে শাস্ত্র বচন তুলে তুলে সংস্কৃত ভাষায় এক ভয়ানক ভাষণ দিয়েছিলেন। “সমাচারচন্দ্রিকা” পত্রিকায় তা বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল। বিদ্যাসাগর সেই বক্তব্যের জবাব স্বরূপ এই রম্য রচনাটি লেখেন। নামকরণের মধ্যে সেই ইতিহাসটুকু কায়দা করে লুকিয়ে রাখা আছে।
আমি সেই যোগ্য ভাইপোর নাতির নাতি হিসাবে “ব্রজবিলাস”-এর কয়েকটি কাহিনি এখানে আধুনিক কালের ভাষায় ঈষৎ সংক্ষেপে তুলে ধরব:
প্রথম কাহিনি:
সাতক্ষীরার জমিদারবাবুর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর দুই স্ত্রী ও চার পৌত্র বিদ্যমান। এক একজন স্ত্রীর একটি করে দুই পুত্র আগেই মারা যাওয়ায় নাতিরাই শ্রাদ্ধশান্তির দায়িত্বপ্রাপ্ত। ঔরস নাতিদের পৈতে হয়নি, দত্তক নাতিদের হয়ে গেছে। বিতর্ক উঠল, শ্রাদ্ধ কে করতে পারে। তাদের গুরুদেব প্রসিদ্ধ পণ্ডিত জানকীজীবন ন্যায়রত্ন বিধান দিলেন, দত্তক নাতিই পৈতের জোরে শ্রাদ্ধের অধিকারী। সেই অনুযায়ী মৃত্যুর চার দিন পর দত্তক নাতিদের উদ্যোগে শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে গেল। অনেক বড় বড় বিদ্যাবাগীশ শ্রাদ্ধসভায় উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁরা “এই শ্রাদ্ধ শাস্ত্রের বিধি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হইল” — এই মর্মে এক বিবৃতিতে নাম স্বাক্ষর করে গেলেন।
তখন অপর (ঔরস) পক্ষও ঠিক করল, তারাও আর একটা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করবে। তার জন্য বিধান প্রার্থনা করে তারাও কয়েকজন বড় বড় বিদ্যাবাগীশকে অনুরোধ জানাল। “ইহা কাহারও অবিদিত নাই, বিদ্যাবাগীশ খুড় মহাশয়েরা ব্যবস্থাবিষয়ে কল্পপ্তরু। কল্পতরুর নিকটে যে যাহা প্রার্থনা করে, সে তৎক্ষণাৎ তাহা প্রাপ্ত হয়। সেইরূপ, বিদ্যাবাগীশ খুড়দের নিকটে যে যেরূপ ব্যবস্থা চায়, সে তাহা পায়, কেহ কখনও বঞ্চিত হয় না। তবে একটু বিশেষ এই, কল্পতরুর নিকট তৈলবট দাখিল করিতে হয় না; বিদ্যাবাগীশ খুড়রা, বিনা তৈলবটে, কাহারও উপর নেক নজর করেন না।” যাই হোক, তাদের দয়ায় এবং উপদেশ অনুসারে এগার দিন পরে আর একবার শ্রাদ্ধ হল। এই সভাতেও বড় বড় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা উপস্থিত থেকে সব কিছু সুসম্পন্ন হতে সাহায্য করলেন।
শ্রাদ্ধের পরেই জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি ২৪ পরগণার কালেক্টরের হাতে গেল। উভয় পক্ষই দেনা করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করায় টাকার জন্য কালেকটরের কাছে যেতে হবে। অনেকের একবার শ্রাদ্ধই ভালো করে করা যায় না, এক ব্যক্তির মৃত্যুতে দুবার করে শ্রাদ্ধ কেন করা হল, সাহেব তা জানতে চাইলেন। দত্তক পক্ষের তরফে জানকীজীবন ন্যায়রত্নের বিধানের কথা জানানো হল। তখন বাধ্য হয়ে ঔরস পক্ষ অন্য পণ্ডিতদের বিধান সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে প্রথম শ্রাদ্ধ শাস্ত্রবিধি অনুসারে হয়নি। তারা “অধমতাড়ণ ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন” পণ্ডিতের শরণাপন্ন হল। তিনি বললেন, কোনো অসুবিধা নেই, আমি এমন এক ব্যবস্থার কথা বলব, যাতে দ্বিতীয় শ্রাদ্ধ সিদ্ধ হয়ে যাবে। অতঃপর তিনি এমন এক শাস্ত্রীয় বচন উল্লেখ করলেন, যার দ্বারা “প্রথম শ্রাদ্ধ অসিদ্ধ ও দ্বিতীয় শ্রাদ্ধ শাস্ত্রসিদ্ধ বলিয়া বোধ হইতে পারে”।
একজন তখন প্রশ্ন করলেন, ও পক্ষের ব্যাপারে আপনার কী বক্তব্য?
ব্রজনাথ বললেন, কী আর বলব? আমি তো ও পক্ষের শ্রাদ্ধ ব্যবস্থায় নাম সই দিয়ে এসেছি।
সেই ব্যক্তি আবার বললেন, আপনি তো বেশ লোক। আগে যে ব্যবস্থায় সম্মতি জানিয়ে এলেন, এখন আবার তাকেই শাস্ত্র বিরুদ্ধ বলে বিচার করছেন? যখন ওখানে নাম সই দিচ্ছিলেন, তখন এই শাস্ত্রীয় বচনটি আপনার মনে পড়েনি?
“বিদ্যারত্ন সহাস্য বদনে উত্তর করিলেন, ব্যবস্থা দিবার সময় কি অত বচন ফচন দেখা যায়?”
গল্পটি বিবৃত করার পর বিদ্যাসাগর আপন বয়ানে বললেন, “নবদ্বীপ এদেশের সর্বপ্রধান সমাজ; বিদ্যারত্ন সেই সমাজের সর্বপ্রধান স্মার্ত বলিয়া গণ্য ও মান্য; তাঁহার চাঁদমুখে স্বকর্ণে শুনিলাম, ব্যবস্থা দিবার সময় বচন ফচন দেখা যায় না। জানকীজীবন ন্যায়রত্ন যথাশাস্ত্র ব্যবস্থা দিয়াছিলেন। বিদ্যারত্ন খুড় পূর্বে ঐ ব্যবস্থায় নাম স্বাক্ষর করিয়াছেন; কিন্তু অপর পক্ষের নিকট হইতে পছন্দসই তৈলবট হস্তগত করিয়া আজ আবার ঐ ব্যবস্থা অব্যবস্থা বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে প্রবৃত্ত। এ দেশের মুখে ছাই; এদেশের সর্বপ্রধান সমাজের মুখে ছাই; এদেশের সর্বপ্রধান সমাজের সর্বপ্রধান স্মার্তের মুখে ফুলচন্দন।যাঁহাদের এরূপ ব্যবহার, তাঁহাদের সহিত কিরূপ ব্যবহার করা উচিত ও আবশ্যক, এ হতভাগা দেশের হতভাগা লোকের সে বোধও নাই, সে বিবেচনাও নাই।”
আর সেই সঙ্গেই ঘোষণা করলেন, “যদি কেহ আমাকে ব্রাহ্মণ ভাবে, তাহাতে আমার যৎপরোনাস্তি অপমান বোধ হয়।”
“ব্রজবিলাস” থেকে এরকম গল্প আরও দুচারটে উল্লেখ করব পরবর্তী পর্বে।
কেন না, ব্রাহ্মণ্যবাদ আজও মরেনি। সিনেমার কাহিনির মতো রাস্তায় মৃতভাব দেখিয়ে শুয়ে আছে এবং শত্রু পেলেই সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হামলা চালাবে।
বিদ্যাসাগরের কর্ম ও চরিত্রও সেই ভাবেই আজও আক্রমণের লক্ষ্য।
নানান নামে এবং বেনামে।
[৮]
যেমন কথা তেমন কাজ! বিদ্যাসাগরের “ব্রজবিলাস” নামক রম্য রচনা থেকে আরও দুটো গপ্পো আমি এখানে পুনরুদ্ধার করব বিদ্যাসাগরের ধর্ম এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ সম্পর্কে আন্তরিক মনোভাব বোঝার স্বার্থে। মাঝে মাঝে কিছু আগ্রহপূর্ণ অংশ হুবহু উদ্ধৃতি দিয়ে তুলে দেব।
দ্বিতীয় কাহিনি: অথ নরক দর্শন
লেখকের বয়ানে জানা যায়, তিনি যা লিখছেন তাতে যদি প্রাচীনপন্থীরা রাগও করেন, তাতে তার কিছু বয়ে যাবে না। তিনি এসমস্ত বিষয়ে কারও তোয়াক্কা করেন না, এজন্যে যদি নরকেও যেতে হয়, তাতেও তিনি রাজি আছেন।
যদি বলেন, নরক কেমন সুখের স্থান যদি জানতে, তাহলে কখনই নরকে যেতে চাইতে না — এ বিষয়ে একটি গল্প বলি: কিছু দিন আগে কলকাতার এক ভদ্র সন্তান একেবারে বখে যাচ্ছিল দেখে তাদের পারিবারিক গুরুদেব তাকে নরকের ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই সুবোধ সুশীল বিনয়ী ভদ্র সন্তান তখন উত্তর দেয়, আপনি দেখুন, যত প্রবল প্রতাপ রাজা রাজড়া, সব নরকে যাবে; যত ধনে মানে পূর্ণ বড় লোক সব নরকে যাবে; যত দিলদরিয়া তুখোড় ইয়ার, তারাও নরকে যাবে; যত মৃদুভাষিণী চারুহাসিনী বারবিলাসিনী সকলে সেই নরকে গমন করবে; স্বর্গে যাবে শুধু আপনাদের মতো টিকিকাটা বিদ্যাবাগীশের দল। সুতরাং নরকে যাওয়াই সর্বাংশে বাঞ্ছনীয়। আমিও তাই বলি।
তবে একটি বিষয়ে সেই ভদ্র সন্তানের সঙ্গে আমার মতের অমিল আছে। “আমার কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস এই, যদি নরক নামে বাস্তবিক কোনও স্থান থাকে; এবং কাহারও পক্ষে সেই নরক পদবাচ্য স্থানে যাইবার ব্যবস্থা থাকে; তাহা হইলে টিকি কাটা বিদ্যাবাগীশের পাল সর্বাগ্রে নরকে যাইবেন, এবং নরকের সকল জায়গা দখল করিয়া ফেলিবেন; আমরা আর সেখানে স্থান পাইব না।”
কেন, বিদ্যাবাগীশদের অপরাধ কী?
তারা শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মনগড়া বচন পড়ে থাকেন; সাধারণ লোকদের ঠকান; তাদেরটা জেনেশুনে পাপ। সেই পাপের ফল থেকে নিষ্কৃতি নেই। গেরস্ত লোকেরা শাস্ত্র না জেনে অজ্ঞতা বশত অনেক অন্যায় করে ফেলে। তারা নরকে কম যাবে। কিন্তু বিদ্যাবাগীশদের শাস্ত্রেও যেমন দখল, পাপেও তেমনি প্রবৃত্তি; সুতরাং তাদের পাপের সংখ্যাও অনেক এবং সমস্ত পাপই সজ্ঞানে। তাই তারাই নরক একচেটিয়া দখল করে ফেলবে। সে ব্যাপারে অণু মাত্র সংশয় নেই।
এই অবধি পড়ে কারও যদি সৈয়দ মুজতবা আলীর কোনো গল্পের কথা মনে পড়ে যায় আমি তার জন্য দায়ী নই।
ব্রাহ্মণদের শাস্ত্র ব্যাখ্যার নজির হিসাবে এবার তৃতীয় কাহিনির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক:
কিছু দিন আগে এই পরম পবিত্র গৌড়দেশে কৃষ্ণহরি শিরোমণি নামে এক সুপণ্ডিত, অতি প্রসিদ্ধ কথক আবির্ভূত হয়েছিলেন। যারা তার কথা শুনতেন, সকলেই মোহিত হয়ে যেতেন। একজন মধ্য বয়স্ক বিধবা প্রতিদিন তার কথা শুনতে যেতেন। কথা শুনে তিনি এত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে সন্ধ্যার পর অবাধে তার বাসায় গিয়ে তার পরিচর্যা করতেন। কালক্রমে ঘনিষ্ঠতা হতে হতে অবশেষে সেই রমণী শিরোমণি মশাইয়ের প্রকৃত সেবাদাসী হয়ে পড়লেন।
একদিন শিরোমণি মশাই ব্যাসাসনে বসে স্ত্রীজাতির ব্যাভিচার সম্পর্কে নানা রকম দোষের কথা বর্ণনা করে শেষে বললেন, ‘যে নারী পরপুরুষে উপগতা হয়, নরকে গিয়া তাহাকে অনন্ত কাল যৎপরোনাস্তি শাস্তি ভোগ করিতে হয়। নরকে এক লৌহময় শাল্মলি বৃক্ষ আছে। তাহার স্কন্ধদেশ অতি তীক্ষ্ণাগ্র দীর্ঘ কণ্টকে পরিপূর্ণ। যমদূতেরা ব্যাভিচারিণীকে সেই ভয়ঙ্কর শাল্মলি বৃক্ষের নিকটে লইয়া গিয়া বলে, তুমি জীবদ্দশায় প্রাণাধিক প্রিয় উপপতিকে নিরতিশয় প্রেমভরে যেরূপ গাঢ় আলিঙ্গন করিতে, এক্ষণে এই শাল্মলি বৃক্ষকে উপপতি ভাবিয়া সেইরূপ গাঢ় আলিঙ্গন কর। সে ভয়ে অগ্রসর হইতে না পারিলে, যমদূতেরা যথাবিহিত প্রহার ও যথোচিত তিরস্কার করিয়া বলপূর্বক তাহাকে আলিঙ্গন করায়; তাহার সর্ব শরীর ক্ষত বিক্ষত হইয়া যায়; সে যাতনায় অস্থির ও মৃতপ্রায় হইয়া অতি করুণ স্বরে বিলাপ, পরিতাপ ও অনুতাপ করিতে থাকে। এই সমস্ত অনুধাবন করিয়া কোনও স্ত্রীলোকেরই অকিঞ্চিতকর ক্ষণিক সুখের অভিলাষে পরপুরুষে উপগতা হওয়া উচিত নহে’ ইত্যাদি। এই পর্যন্ত বলে তিনি সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে এক পরম আধ্যাত্মিক তৃপ্তির হাসি হাসলেন।
এদিকে, ব্যাভিচারিণী নারীর পরলোকে নরকে গিয়ে এরকম ভয়ানক শাস্তি ভোগের কথা শুনে সেই বিধবা রমণী ভয়ে ও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘যা করে ফেলেছি করেছি, আর না; এর পর থেকে আমি আর মরে গেলেও পরপুরুষে উপগত হব না।’ সেদিন সন্ধ্যার পর তিনি আগের মতোই শিরোমণি মশাইয়ের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে করণীয় অন্যান্য সব রকম পরিচর্যা সম্পন্ন করলেন; কিন্তু অন্য দিনের মতো গুরুদেবের চরণ সেবার জন্য তার শয়ন কক্ষে আর প্রবেশ করলেন না।
শিরোমণি মশাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন; অবশেষে দেরি দেখে অধৈর্য হয়ে তার নাম ধরে বারবার ডাকতে লাগলেন। সেবাদাসী ঘরে না ঢুকে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে গলবস্ত্র সহকারে হাত জোড় করে চোখের জলে ভেসে শোকার্ত কণ্ঠে বললেন, ‘প্রভু, দয়া করে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার বচনে নরক লোকে শিমূল গাছের উপাখ্যান শুনে পর্যন্ত আমি ভয়ে মরে আছি; আপনার চরণ সেবা করতে আর আমার কোনো মতেই প্রবৃত্তি বা সাহস হচ্ছে না। না জেনে যে অপরাধ করে ফেলেছি, তার হাত থেকে কীভাবে নিস্তার পাব, সেই ভেবে আমি অস্থির হয়ে আছি।’
বিধবার কথা শুনে পণ্ডিত চূড়ামণি শিরোমণি মশাই বিছানা থেকে নেমে পড়লেন এবং দরজার ধারে এসে সেই ভীত সন্ত্রস্ত সেবাদাসীর হাতদুটি ধরে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আরে পাগলি! তুমি এই ভয়ে আজ শয্যায় যাইতেছ না? আমরা পূর্বাপর যেরূপ বলিয়া আসিতেছি আজও সেই রূপ বলিয়াছি। সিমূল গাছ পূর্বে ঐরূপ ছিল যথার্থ বটে; কিন্তু শরীরের ঘর্ষণে ঘর্ষণে লৌহময় কণ্টক সকল ক্রমে ক্ষয় পাওয়াতে [সেই] সিমূল গাছ [এক্ষণে] তেল হইয়া গিয়াছে; এখন আলিঙ্গন করিলে সর্ব শরীর শীতল ও পুলকিত হয়।’
এই বলে অভয় প্রদান করে প্রলোভন দেখিয়ে শয্যায় নিয়ে গিয়ে গুণমণি শিরোমণি মশাই সেই বিধবা রমণীকে আবার রুটিন চরণসেবায় লাগিয়ে দিলেন।
ইতিমধ্যে, এই গল্পগুলি আম জনগনের মধ্যে প্রচার করতে না করতেই বিদ্যাসাগরের ফুটোস্কোপিক গবেষকরা খুঁজে বের করেছেন এক সাংঘাতিক খবর। “ব্রজবিলাস” নাকি বিদ্যাসাগরের রচনা নয়। ১৮৭৫ সালে রচিত উইলে বিদ্যাসাগর নিজেই তাঁর রচনাবলির যে তালিকা তৈরি করেছিলেন, তাতে এর নাম নেই। আশ্চর্য তো মশাই। ১৮৭৬ সালে যে বইটি তিনি লিখবেন, সেটি তিনি ১৮৭৫ সালের উইলে ঢোকালেন না? অদ্ভুত ভুলো মন তো! এর পরে আর কথা কী? ও, হ্যাঁ, বিদ্যাসাগরের পরিত্যক্ত পুত্র নারায়ণ চন্দ্রও তাঁর পিতার রচনাবলি বের করার সময় “ব্রজবিলাস”, “অতি অল্প হইল”, “আবার অতি অল্প হইল”, ইত্যাদি পুস্তিকাগুলি ছাপাননি। ভারি বুদ্ধিমান ছেলে বইকি! পিতা যখন ছদ্মনামেই লিখেছেন, তখন আর ওগুলো বের করে সমাজের মাতব্বরদের কুনজরে পড়ি কেন! তবে কথা হল, ১৯৭২ সালে নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি যখন প্রসিদ্ধ মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবী গোপাল হালদারের সম্পাদনায় অত্যন্ত যত্ন সহকারে তিন খণ্ডে বিদ্যাসাগর রচনাবলি বের করে, তখন তার তৃতীয় খণ্ডে এই রচনাগুলি স্থান পায়। আমারও সংগ্রহ সেখান থেকেই।
আরও লক্ষণীয়, সরোজ দত্ত নিহত হলেও বিনয় ঘোষ তখন দিব্যি বেঁচে ছিলেন। সন্দেহ-টন্দেহ হলে বিদ্যাসাগর বিশারদ হিসাবে তিনি আপত্তি জানাতেন নিশ্চয়ই। সুশোভন সরকার, অমলেন্দু দে, বরুণ দে, প্রমুখ ঘোষ-দত্ত পন্থী বড় বড় মার্ক্সবাদী বিশ্লেষকরাও সকলেই সেই সময় ইহধামে সুখে শান্তিতে বিরাজমান ছিলেন। এই লেখাগুলো বিদ্যাসাগরের নয় বলে জানলে ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন মহাশয়ের আধার লিঙ্ক খুঁজে বের করে তাঁরা সেদিনই হুলুস্থুলু কাণ্ড বাধিয়ে সেই কথিত “ভাইপো”টির পাকামি বন্ধ করে দিতেন!! দেননি যে এই আমাদের ভরসা।
যাই হোক, বিদ্যাসাগরের এই রচনাটির এতকাল কেন কোনো রকম প্রচার হয়নি, আমাদের শিক্ষাক্রমের কোনো স্তরেই এর একটিও কাহিনির কেন জায়গা হয়নি, এমনকি বামপন্থী যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক আন্দোলনের তাত্ত্বিক চর্চায়ও কেন এর তেমন ব্যবহার ঘটেনি — এখন সময় হয়েছে সেই হিসাবটির নিকাশ করার। ব্রাহ্মণ্যবাদ এই দেশে এত শক্তিশালী এবং এত রকম ভাবে সূক্ষ্ম কায়দায় ক্রিয়াশীল যে ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ থেকে তাড়ানোর সময় সে যে স্থূল মূর্তি ধারণ করে, বিদ্যাসাগরের ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী অবস্থানকে বিরোধিতা করার সময় তা করে না। কেন না, অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করে আধুনিক বীজগণিত শিক্ষার সমস্ত আধুনিক ধাপে তিনি আমাদের মনন সত্তায় এক চিরস্থায়ী আসন লাভ করে বসে আছেন। সেখান থেকে তাঁকে হঠায় সাধ্য কার?
অথচ হঠাতে তো হবেই। উপায় কী?
উপায় দুটো।
এক, আম জনতার জন্য বিদ্যাসাগরের এক ভিন্ন ভাবমূর্তি নির্মাণ করে দাও। পিতৃভক্তি মাতৃভক্তির এক ধ্রুপদী উদাহরণ হিসাবে তাঁকে চিত্রায়িত কর। পিতামাতাই তাঁকে সমাজ সংস্কারে উদ্বুদ্ধ করেছেন বলে গল্প বানাও। মায়ের আহ্বানে দুস্তর দামোদর নদী সাঁতরে পেরনোর গল্প বল। প্রয়োজনে ছবি এঁকে দেখাও, কীভাবে ঢেউ ঠেলে ঠেলে সাঁতার কেটে এক মাতৃভক্ত সন্তান অন্ধকার রাত্তিরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। ভুলিয়ে দাও, বাস্তবে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের আন্দোলন করতে গিয়ে বাবা মা থেকে শুরু করে সমস্ত আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একদম ছেদ হয়ে গিয়েছিল। দয়ার সাগর দান সাগর ইত্যাদি সুখ্যাতির আড়ালে তাঁর ধর্মত্যাজী ব্রাহ্মণ্যবাদ খণ্ডক কর্মকাণ্ডকে বিস্মৃতির গুদামে ফেলে দাও। “”ব্রজবিলাস” এবং “অতি অল্প”-গ্রন্থিকাদ্বয়ের বিদ্যাসাগরকে যেন কেউ মনে না রাখে। তারপর ছবি টাঙিয়ে তার সামনে যত খুশি ফুল-মালা দিতে থাক। ছবির সামনে ধুপধুনো দিতেও ভুলো না! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গানের কলির ঈষৎ বাচ্যান্তরে বলতে থাক, “তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলিয়ে রাখি!”
হ্যাঁ, তোমাকে আমরা অনেকগুলো সাগর খেতাব দান করেছি। কিন্তু তুমি আমাদের ঋষি নও; সেকালের ঋষি আমাদের কাছে একজনই — বঙ্কিমচন্দ্র। যিনি ব্রাহ্মণ্যবাদকে রক্ষার জন্য জানপাত করে লড়াই করেছিলেন। {অরবিন্দকেও অবশ্য পরে আমরা ঋষির আসন দিয়েছি। ঠিক সময়ে, যখন তাঁর মতো একজন বুদ্ধিমান নেতার দরকার ছিল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে, তিনি অধ্যাত্মরসে জারিত বা তাড়িত হয়ে কী চমৎকারভাবেই না সরে গেলেন!} ব্রিটিশ আর ব্রাহ্মণ্যবাদ — দুপক্ষকেই তিনি প্রাণ ভরে আশীর্বাণী দিয়ে গেছেন।
দুই, আর যারা পড়াশুনো করতে চায়, তাদের জন্য কিছু তাত্ত্বিক পাঠ নির্মাণ কর। পাণ্ডিত্যপূর্ণ সন্দর্ভ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ কর, এদেশে ব্রাহ্মণ্যবাদ কোনো দিনই তেমন ভয়াল রূপে ছিল না। বলে যাও, ইংরেজ আসার আগে ব্রাহ্মণরা শূদ্রদের কোলে বসিয়ে দুধ খাওয়াত! জাত-ফাত নিয়ে লালন ফকিরের গান বাজে কথা! একজন গ্রাম্য অশিক্ষিত লোকের আর বুদ্ধিসুদ্ধি কতই বা হবে! মহারাষ্ট্রে সাবিত্রীবাই ফুলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় তাঁর গায়ে উচ্চ বর্ণের লোকেদের প্রতিদিন রাস্তায় কাদা ছুঁড়ত? হতেই পারে না। এই সব ঘটনা হয়ত কমিউনিস্টদের অপপ্রচার! তিনি অতিরিক্ত কোনো শাড়ি ব্যাগে না নিয়েই নিশ্চিন্তে স্কুলে যেতেন। এবং ঘরে ফিরেও আসতেন। সারা দেশে তখন লক্ষ লক্ষ স্কুল হাজার হাজার কলেজ শত শত ইউনিভার্সিটি ছিল। সেই সব শিক্ষাকেন্দ্রে ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে কোটি কোটি লোককে বর্ণমালা থেকে ক্যালকুলাস, নদী থেকে গ্যালাক্সি, ডারউইন থেকে আইনস্টাইন — সব শেখানো হত। বিজেপি বলছে সেগুলো সবই মুসলমান শাসকরা নাকি খেয়ে ফেলেছে। রবীন্দ্রনাথ আবার তা নিয়ে আগাম ব্যঙ্গ করে যাওয়ার ফলে [চতুরঙ্গ] সেকথা অনেক লোকে আজকাল আর তেমন একটা বিশ্বাস করে না। সুতরাং এখন বলতে হবে, ইংরেজরা এসে সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। রামমোহন আর বিদ্যাসাগরের মতো দেশি পরগাছাদের হাত দিয়েই! হ্যাঁ, উড, অ্যাডাম, হান্টার, মেকলে প্রমুখ সাহেবদের দিয়ে আগে সমীক্ষা করে একটা বড় হিটলিস্ট বানিয়ে নিয়েছে। তারপর ধরে ধরে . . .। এইভাবে ডকুমেন্ট-টকুমেন্ট সহযোগে লিখতে পারলে শিক্ষিত লোকদের কাছে বিদ্যাসাগরের গ্রহণযোগ্যতা অনেক খানি কমিয়ে দেওয়া যাবে। তারপর তারাই আবার স্তরে স্তরে . . .।
বিদ্যাসাগরকে বদমাশ সাহেবদের দালাল প্রতিপন্ন করার জন্যই ভালো ভালো আসল উপনিবেশোত্তর সাহেবদের বই থেকে বড় বড় উদ্ধৃতি দিতে হবে। বিদ্যাসাগর তো আর পালটা আমাদের দালাল বলতে এখন ফিরে আসবেন না! অতএব চিন্তা কী? মাভৈঃ
সুতরাং, সেই মূর্তি ভাঙার কাজ এই দেশে এখনও চলছে। কলমবীর “শশাঙ্ক”-র অনুপস্থিতিতে কোনো অসুবিধা নেই। তাঁর অনুগামীরা তো আছেন। ভিন্ন ছদ্মবেশে। বা বিভিন্ন ছদ্মবেশে। হয়ত আরও বহু দিন চলতেই থাকবে। ব্রাহ্মণ্যবাদকে বাঁচিয়ে রাখার অগোচর আবেগ-আদেশে। কিন্তু যত চলবে, ততই বিদ্যাসাগর প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন। আরও নতুন “ব্রজবিলাস” লিখবার জমি এবং চরিত্র তৈরি হবে।
পঞ্চম পর্ব এই লিঙ্কে
লেখক পরিচিতি: ‘সেস্টাস’ নামে বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কিত মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক। বিজ্ঞান ও মার্কসবাদের আলোয় বিজ্ঞানের ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ে লোকপ্রিয় প্রবন্ধের লেখক।
“তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি…”। এহ বাহ্য। বড় ভালো, দরকারি লেখা। তবে আমাদের মুশকিল এই যে আমরা বিন্দুতেই সিন্ধুদর্শন করে থাকি। এখন সামনে সাক্ষাৎ সিন্ধু দেখে ভাবছি, কত কী যে বোঝার ছিল, কিছুই জানা হয়ে উঠল না। তবুও যে এই সান্ধ্যবয়সে কিছু খোরাক পাচ্ছি সেটুকু ভাবলেও ভালো লাগে। তাই লেখা চলুক।