উঃ ২৪ পরগনার ৩০টি গ্রাম জুড়ে খাদান শ্রমিকরা সিলিকোসিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। মালিকপক্ষ ও তাদের মদত দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর উপরে ভরসা হারিয়ে ন্যায্য দাবি নিয়ে পথে নামলেন সাধারণ মানুষ। লিখছেন বর্ণব।
২০১২, গণশক্তি পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় সিলিকোসিস নিয়ে, সেই প্রথম পরিচয় ‘সিলিকোসিস’ নামটার সাথে। সংবাদটি ছিল মিনাখার গোয়ালদহ গ্রামে একশ’র উপর মানুষ সিলিকোসিসে আক্রান্ত। গণশক্তির সংবাদটি পরার পর গুগল সার্চ করা শুরু করি আমরা সিলিকোসিস নিয়ে বিশদে জানতে। যা জানতে পারি তার সংক্ষিপ্তকরণ হল – silicosis is a from of occupational lung disease caused by inhalation of crystalline silica dust। এরপর আমরা খুঁজতে শুরু করি সিলিকোসিস নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের কোনও তথ্য যদি পাওয়া যায়, কিন্তু সিলিকোসিস নিয়ে বিশ্বের নানা দেশের তথ্য থাকলেও ভারতে সিলিকোসিস আক্রান্তের কোন তথ্য আমরা সেই সময় পাইনি। সিদ্ধান্ত নিই গোয়ালদহ গ্রামে যাব অনুসন্ধানের জন্য। গণশক্তির সংবাদ অনুযায়ী প্রচন্ড দারিদ্রের মধ্যে ছিল গ্রামটি, তাই আমরা যতটা সম্ভব চাল, ডাল সহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার “আমরা” বলতে আমাদের একটি ছোট সংগঠন ছিল – শান্তি গণতন্ত্র সংহতি মঞ্চ।
কলকাতা থেকে ৪৫-৫০ কিলোমিটার দূরে গোয়ালদহ গ্রাম, গ্রামে ঢোকার কিছুটা আগে, মিনাখা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সেই সময় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি ছিল সিলিকোসিস আক্রান্ত আবুল। গায়ে ছোট ছোট ঘা এবং নাকে ২৪ ঘন্টার জন্য অক্সিজেনের নল। আবুলকে দেখে তার সাথে কথা বলে আমরা গ্রামে প্রবেশ করি। ছবির মত সাজানো গ্রাম অথচ দারিদ্র্য় গ্রামবাসীর চেহারায় পরিষ্কার। আমরা যখন চাল-ডাল দিতে শুরু করলাম মনে হচ্ছিল আফ্রিকার কোন হতদরিদ্র দেশে এসে পড়েছি। গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলে যে যে তথ্য পেলাম তা এই রকম – গ্রাম থেকে প্রায় ১৮০ জন পাথর খাদানে কাজে গেছিল, আসে পাশের গ্রাম দেবীতলা, সাঁওতাল পাড়া থেকেও প্রচুর মানুষ পাথর খাদানে কাজে গেছিল, ইতিমধ্যে পাঁচ জন মারা গেছেন, প্রথম দিকে তারা বোঝেনই নি যে তারা কেন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন; যখন বুঝেছে তখন সবাই পালিয়ে আসে। আমি নিজে ডকুমেন্টেশন করার জন্য ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম। ক্যামেরার ফ্ল্যাশে গ্রামের প্রতিটি বাচ্চা কাঁদতে শুরু করে, আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি ওই গ্রামে তখন পর্যন্ত ক্যামেরা পৌঁছায়নি। গ্রামের মধ্যে ধর্ম এবং রাজনৈতিক ভেদাভেদও সেই দিন স্পষ্ট ছিল। আমরা ফেরার দু’সপ্তাহ পর আবুল মারা যায়। আমরা বুঝতে পারি এই গ্রামের পাশে দাঁড়ানোটা আমাদের রাজনৈতিক কর্তব্য, কারণ প্রতিটি মানুষ শ্রেণীর মানুষ, তাই দল নয় শ্রেণী।
কলকাতায় ফিরে আমাদের প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল ওই গ্রামে অবিলম্বে মেডিক্যাল ক্যাম্প করা দরকার । পরবর্তী দুবছর আমরা গোয়ালদহ গ্রামে মেডিক্যাল ক্যাম্প করি পাশাপাশি যেভাবে সম্ভব যতটুকু সম্ভব চাল-ডাল দেওয়ার চেষ্টা করি। ইতিমধ্যে অনেক গুলো সংগঠন এই গ্রামে সাহায্য করা শুরু করে তাদের মত করে। কিন্তু মেডিক্যাল ক্যাম্প, চাল-ডাল দিয়ে তো আর মৃত্যু মিছিল আটকানো যায় না। এই সময় একের পর এক সিলিকোসিস আক্রান্ত খাদান শ্রমিক মারা যেতে থাকে। আসে পাশের গ্রাম থেকেও মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করে আমাদের কাছে। বহু নতুন গ্রামের সন্ধান পাওয়া যায় যারা পাথর খাদানে কাজ করতে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে গোয়ালদহ গ্রামের সাথে আমাদের সম্পর্ক পরিবারের মত হয়ে ওঠে। গ্রামে কাজ করার ক্ষেত্রে আগে গ্রামবাসীর আস্থা এবং বিশ্বাস অর্জন জরুরি। এবং এই দুই বছর ধরে আমরা সেই আস্থা বিশ্বাসের জায়গাতে কিছুটা পৌঁছাই। সঙ্গে আমরা গ্রামবাসী কে বোঝাতে কিছুটা সক্ষম হই যে “আপনার হিন্দু বা মুসলিম হতে পারেন, সিপিআইএম বা টিএমসি বা অন্য কোন রাজনৈতিক দল করতে পারেন। কিন্তু সবার আগে আপনার শ্রমিক। ধর্ম রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে গ্রামের প্রায় সকলে সিলিকোসিসে আক্রান্ত। সিলিকোসিস ধর্ম রাজনৈতিক দল দেখে হয় না। তাই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শ্রমিকদের জোট বাঁধা দরকার।”
পরবর্তী সময়ে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, দৃঢ় হয়েছে লড়াইয়ের মানসিকতা। আমরা মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে এবং গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় গোয়ালদহ গ্রামে গড়ে তুলি একটি দুই বেডের সেবা কেন্দ্র। সিলিকোসিস আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীর প্রয়োজন ২৪ ঘন্টার অক্সিজেন। এমনিতে গরিব তার উপর দিনে চারটে অক্সিজেন সিলিন্ডার সঙ্গে নানা ওষুধ-খাদান শ্রমিকের পরাবার দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে শুরু করেছে। সেই সময় আমরা এবং বিভিন্ন সংগঠন অক্সিজেন এবং ওষুধের ব্যবস্থা করি কিন্তু তা দরকারের থেকে অতি সামান্য। এত মানুষকে এভাবে অর্থনৈতিক ভাবে সাহায্য করা কোন সংগঠনের সম্ভব নয়। তাই আমরা রাস্তার লড়াইয়ের সাথে কলকাতা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হই। হাইকোর্টের কেসের মূল আবেদন করেন আক্রান্ত শ্রমিকরাই । সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আক্রান্ত গ্রাম এবং মৃতের সংখ্যা।
কিন্তু কৃষকরা কেন হঠাৎ পাথর ভাঙতে গেল? আসলে আয়লার পর সুন্দরবন সংলগ্ন বহু গ্রামে চাষের জমি নোনা জলে নষ্ট হয়ে যায়। কৃষকরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। কৃষির আনুষঙ্গিক জিনিসের দাম বাড়ায় কৃষিকাজও লাভজনক নয়। বিভিন্ন গ্রামের বহু যুবক কর্মহীন। ফলে পেট এবং পরিবারের স্বার্থে কৃষকের কাস্তে রূপান্তরিত হয় হাতুড়িতে। দলে দলে বহু কৃষক ভিড় জমাচ্ছে শহরে এবং পরিবর্তিত হচ্ছে সস্তা শ্রমিকে। পাথর খাদানে কাজ ছিল একটু ভালো থাকার হাতছানি। কিন্তু রাষ্ট্রের সহযোগিতায় এই সুরক্ষাহীন বৈধ অবৈধ খাদান এবং অতি মুনাফার লোভ হয়ে উঠেছে শ্রমিকদের জন্য কসাই খানা।
ভয়াল সিলিকোসিস কেড়েছে শ্রমিকের বাঁচার অধিকার, ফুসফুসে পাথরকুচি নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় ওরা। পেট চালাতে পাথর ভাঙতে গিয়েছিলেন ওঁরা। পাথরভাঙা কলে নিংড়ে দিয়েছিলেন নিজেদের। বুঝতেই পারেননি যে, একটু একটু করে জড়িয়ে পড়েছেন মৃত্যুফাঁদে। যখন বুঝলেন, ততক্ষণে ফুসফুসে পাথরকুচি আর বিষাক্ত গ্যাস জমে ওঁরা মৃত্যু পথযাত্রী। পাথর ভাঙা কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে সিলিকোসিস বেশি দেখা যায়। পাথরের ধুলিকণা নাক, মুখ এমনকি চোখ দিয়ে ঢুকলে শ্রমিকরা এ রোগে আক্রান্ত হন। রোগের লক্ষণ হিসেবে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেয়। হাত-পা শুকিয়ে যেতে থাকে। শেষ পরিণতি মৃত্যু। ভূমি খনন করে পাথর উত্তোলন, পাথর নেটিং, ডাম্পিং ও ক্র্যাশিংয়ের সময় নাক মুখ দিয়ে ধুলাবালি শরীরে প্রবেশ করে। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছেন পাথর শ্রমিকরা। ফুসফুসের এই দুরারোগ্য রোগে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে। আগেই বলেছি, সিলিকোসিস রোগীর প্রয়োজন অক্সিজেন ও জরুরি ইঞ্জেকশন। কিন্তু এই গ্রামের কৃষক থেকে শ্রমিকে পরিণত হওয়া মানুষ এতটাই গরিব যে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। হাড় জিরজিরে শরীরগুলো ক্রমশ বিছানায় মিশে যাচ্ছে। কাশির দমকে কারও মুখ থেকে রক্ত ওঠে। কেউ বা বুক ভরে বাতাস টানতেই জেরবার। ভারতের গ্রামের পর গ্রাম একই ছবি। সারা ভারতে সিলিকোসিস আক্রান্তের ছবিটা ভয়ঙ্করতম। এই মুহূর্তে ভারতে সিলিকোসিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দেড়কোটি। শ্রমিকরা আক্রান্ত এবং মৃত্যু পথযাত্রী হলেও পাথর খাদানগুলো বন্ধ হয়নি। এই মুহূর্তে দুকোটি বা তার বেশি মানুষ এই সব খাদানে কর্মরত। অদূর ভবিষ্যতে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াবে তিন কোটিতে। আক্রান্ত শ্রমিকের সাথে তার পরিবারও সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছে। তিনকোটি শ্রমিকের যদি গড়ে ৫ জনের পরিবার হয় তাহলে সর্বস্বান্ত হওয়ার সংখ্যাটা দাঁড়ায় প্রায় পনেরকোটি। শুধু পাথর খাদান নয়, ইটভাটা, সিমেন্ট কারখানা, এডবেস্টস এর কাজ, বিভিন্ন খনিজের খাদান, পরিবহন শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক সহ বিভিন্ন ধাতুর কাজের শ্রমিকরা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে সংখ্যাটা কোথায় যেতে পারে তা একবার ভাবুন।
সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী দেশ আমেরিকা। ১৯৩৮ এর আমেরিকা; সেই সময় দাড়িয়ে তারা সিলিকোসিস এর বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে লড়াই করেছিল। নিজেদের দেশের মানুষকে রক্ষা করতে সেই সময়ের আমেরিকান মিডিয়া সিলিকোসিসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আজ আমেরিকা প্রায় সিলিকোসিস মুক্ত। ২০১৮-এর ভারতে ১৫০টির উপর কমিউনিস্ট পার্টি । এই মুহূর্তে প্রায় ১.৫ কোটি শ্রমিক আক্রান্ত সিলিকোসিসে। আরও ১.৫ কোটি শ্রমিক পাথর খাদানে এই মুহূর্তে কাজ করছে যারা ধিরে ধিরে সিলিকোসিসের মৃত্যু ফাঁদের দিকে এগোচ্ছে। মিডিয়া সম্পূর্ণ চুপ, কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ভূমিকা নেই প্রায়, দক্ষিণপন্থী পার্টিগুলো স্বাভাবিক ভাবে পুঁজির পক্ষে, মালিকের পক্ষে, শ্রমিক হত্যার পক্ষে। রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা, নীতি নেই সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকদের জন্য। আসলে সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকরা মারা যাচ্ছে না মালিকপক্ষের হাতে রাষ্ট্রের সহযোগিতায় খুন হচ্ছেন প্রতিদিন। ভারতে এক কোটি মানুষ সিলিকোসিসে আক্রান্ত যার অর্থ এক কোটি মানুষেরই মৃত্যু অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণীর হত্যা মালিকের দ্বারা রাষ্ট্রের সহযোগিতায়।
শুধু মাত্র উত্তর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ৩০টি গ্রামের প্রায় ৭০০ এর বেশি মানুষ সিলিকোসিসে আক্রান্ত। এই মুহূর্তে মৃতের সংখ্যা ৪১। শেষ মৃতের নাম গিয়াসুউদ্দিন। এই অঞ্চলের দশ জন আক্রান্ত যে কোন মুহূর্তে মারা যেতে পারেন । ফলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ওই অঞ্চলের বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকরা গড়ে তুলেছেন “সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি (SASSC)”। আক্রান্ত গ্রামের মানুষরাই এই কমিটির সমস্ত পদে আছেন । তাই আজ আর আমাদের মঞ্চের (শান্তি গণতন্ত্র সংহতি মঞ্চ) প্রয়োজন নেই এবং আমরা আমাদের মঞ্চ ছুড়ে ফেলে শ্রমিকদের কমিটির বার্তাবহের কাজ করছি। কিন্তু উত্তর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বিস্তর অঞ্চলের মানুষ সিলিকোসিসে আক্রান্ত। বীরভূমের পাঁচামি, মহাম্মদবাজার, লাভপুর, পাকুরের পার্শবর্তী অঞ্চল; মুর্শিদাবাদ; বর্ধমানের আসানসোল, রানীগঞ্জ, বরাকর; পুরুলিয়ার ঝরিয়া বলরামপুর; বাঁকুড়ার সালতরা, ইনদপুর, বাঁকুড়া শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বহু মানুষ সিলিকোসিসে আক্রান্ত এবং চিন্তার বিষয় এই অঞ্চলের মানুষের কাছে কোন রকম সাহায্য এখন পর্যন্ত পৌঁছায়নি তাদের জোট বদ্ধ করা যায় নি। শুধু বীরভূমের একজন ডাক্তার (সুরক্ষার জন্য নাম প্রকাশ করলাম না) একহাজার সিলিকোসিস আক্রান্ত মানুষের ডেথ সাটিফিকেট লিখেছেন। সিলিকোসিস আক্রান্তদের সন্তান, স্ত্রীর, অসহায় বৃদ্ধ বাবা মাদের ভবিষৎ কী, তা কেই জানে না।
এই মুহূর্তের চমকপ্রদ খবর হল –
১। কোন পাথর খাদানের মালিক সিলিকোসিসে মারা যায় না; বরং লাফিয়ে লাফিয়ে তাদের মুনাফা এবং সম্পত্তি দুই বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন।
২। মেডিকেল ব্যবসাতে এদের কল্যাণে মুনাফা বাড়ছে।
৩। এভাবে চলতে থাকলে পেটের দায়ে একদিন এই শ্রমিকদের স্ত্রী নিজের দেহ বিক্রি করতে বাধ্য হবেনই।
৪। এই শ্রমিকদের সন্তানরা হয় আরও সস্তা শ্রমিকে রূপান্তরিত হবে অথবা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের ভাষায় সমাজ বিরোধী হয়ে উঠবে এবং তাকে রাষ্ট্রের শাসকরা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে।
৫। আপনার বাড়ির চকচকে মার্বেল আরও চকচকে হয়ে উঠবে। (আমাদের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মার্বেল লাগানো আছে এবং সেই মার্বেল সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকের রক্তে প্রতি মুহূর্তে ভেসে যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে কলকাতা হাইকোর্ট সিলিকোসিস নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছে। সেগুলো হল –
১. সিলিকোসিস আক্রান্ত প্রতিটি গ্রামে বিনামূল্যে প্রতি মাসে মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে হবে।
২. হরিয়ানা সরকারের মডেলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সিলিকোসিস আক্রান্তদের জন্য একটি পরিকল্পনা খসড়া 28শে নভেম্বর, ২০১৮-এর মধ্যে হাই কোর্টে জমা করতে হবে।
৩. সমস্ত রোগীকে বিনামূল্যে সমস্ত ধরনের ওষুধ সরবরাহ করতে হবে এবং বিনামূল্যে প্রত্যেকের বুকের এক্স-রে করাতে হবে ।
ভারতের মানবাধিকার কমিশন সিলিকোসিস নিয়ে ভারত সরকারের কড়া সমালোচনা করেছে এবং সিলিকোসিসে মৃত সমস্ত শ্রমিকের পরিবারকে অবিলম্বে 4 লক্ষ টাকা দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
“চাই না ইমাম ভাতা
চাই না পুজোর দান
চাইছি শ্রমের দাম
চাইছি ধানের দাম”
গিয়াসুউদ্দিন, আবুল, স্বরজিৎ, খুদেরা জন হেনরিদের সহযোদ্ধা, গত ২৫ তারিখ (অক্টোবর), তাঁদের মা-বাবা, সন্তান, স্ত্রীরা রাস্তা কাঁপলো এই রকম আরো অনেক স্লোগান তুলে। কারোর জুতো ছিড়ে গেছিল, কারোর তেষ্টায় গলা ফাটছিল, কেউ কেউ হাপিয়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝেই – তবু কেউ থেমে যায়নি, সংগ্রামী শ্রমিক মিছিল স্তব্ধ হয়নি। সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে প্রচন্ড আক্রোশে আকাশ কাঁপিয়ে গর্জন করে এগিয়ে চলেছিল বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণীর মিছিল … (আসলে পড়ুন) এগিয়ে চলেছে প্রতি মুহূর্তে।
ওইদিন সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটির ডাকে উত্তর চব্বিশ পরগনার মালঞ্চ থেকে মিনাখা পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিক, স্থানীয় ইট ভাটার শ্রমিক, আঞ্চলিক কৃষক এবং তাদের পরিবার নিজেদের অধিকারের দাবিতে রাস্তা কাঁপিয়ে এই মিছিল সংগঠিত করে ছিল। গোয়ালদহ, দেবীতলা, আদিবাসী গ্রাম, জয়গ্রাম, কুশাগ্র, ধুলহাট, চকধুলহাট, গাতী সহ ৩০টি গ্রামের মানুষ এই মিছিলে অংশ গ্রহণ করেছিল। এই সমস্ত গ্রামে বেশির ভাগ শ্রমিক সিলিকোসিসে আক্রান্ত। মৃতদের গড় বয়স ২৫। আসলে এগুলো মৃত্যু নয়, রাষ্ট্রের সহযোগিতায় মালিকের হাতে শ্রমিকের সরাসরি হত্যা। নিরানব্বই শতাংশ শ্রমিক অবগতই নন সিলিকোসিসের কারণ সম্বন্ধে।
“জন হেনরি্র হাতুড়ি” গানটা নিশ্চই পাঠকদের শোনা আছে। পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে ১৮৭০-এ রেলের পাথুরে সুড়ঙ্গ কাটতে কাটতে মারা যায় জন হেনরি। বিভিন্ন বই এবং গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে জন হেনরিও সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছিল। আজও স্বরজিৎ, গিয়াসুদ্দিনরা সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে, যা আদতে খুন। ২০১৪-তে সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪৩ হাজার শ্রমিক সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সময়ের সাথে মানুষের দাসত্ব কমেনি বরং তার আকার ধর্ম তীব্রতা আরও রুক্ষ এবং নিষ্ঠুর হয়েছে অতি মুনাফার লোভে।
যে দাবিগুলো নিয়ে সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি (SASSC) মিছিল ছিল, সেগুলি হল –
১. মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে হরিয়ানা মডেলের অনুকরণে পশ্চিমবঙ্গের সিলিকোসিস আক্রান্তদের জন্য সরকারি পরিকল্পনা 28শে নভেম্বরের মধ্যে মহামান্য হাই কোর্টে জমা দিতে হবে।
২. সিলিকোসিস আক্রান্ত সমস্ত গ্রামে আক্রান্তদের জন্য বিনামূল্যে প্রতি মাসে মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে হবে এবং ওষুধ সরবরাহ করতে হবে।
৩. খাদানে যাওয়া শ্রমিকদের বিনামূল্যে বুকের এক্স-রে করতে হবে।
৪. সমস্ত অবৈধ খাদান বন্ধ করতে হবে।
৫. অবৈধ খাদানের মালিকদের দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে।
৬. যে সব রাজনৈতিক নেতার বদান্যতায় অবৈধ খাদান চলছে তাদের গ্রেফতার করতে হবে।
২৫শের মিছিলের বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ রূপ যে স্লোগান দিতে দিতে অগ্রসর হয়েছে সেগুলি শুধু সিলিকোসিস আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান নয়, পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতেও গুরুত্বপূর্ণ –
বলছে হেঁকে শ্রমিকের মা /অবৈধ খাদান চলবে না
চলবে না চলবে না
বলছে হেঁকে শ্রমিকের ভাই/ শ্রমিক খুনের শাস্তি চাই
শাস্তি চাই শাস্তি চাই
বলছে হেঁকে শ্রমিকের বাপ শ্রমিক খুনের নেই মাফ
নেই মাফ নেই মাফ
বলছে হেঁকে শ্রমিকের স্ত্রী/ প্রশাসন ছি ছি
ওয়াক থু, ছি ছি
বলছে হেঁকে শ্রমিকের ছেলে/ খাদান মালিক ঢুকবে জেলে
ঢুকবে জেলে ঢুকবে জেলে
বলছে হেঁকে শ্রমিকের মেয়ে/ শ্রমিক মিছিল আসছে ধেয়ে
আসছে ধেয়ে আসছে ধেয়ে
খাদান শ্রমিক দিচ্ছে ডাক/ অবৈধ খাদান নিপাত যাক
নিপাত যাক নিপাত যাক
ঢের শুনেছি হচ্ছে হবে/ ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে কবে
দিচ্ছো কবে দিচ্ছো কবে
হিন্দু মুসলিম শিখ সাই/ শ্রমিকের কোন জাত নাই
হিন্দু মুসলিম শিখ সাঁই/ গরীবের কোন জাত নাই
কাল নয় আজ চাই ১০০ দিনের কাজ চাই
ভুখা পেটে বলছি তাই/ খাবার পাতে ভাত চাই…
শেষে সকল পাঠকের কাছে আবেদন আপনারা দায়িত্ব নিন এবং এগিয়ে আসুন বৃহত্তর শ্রেণী ঐক্য গড়ে এই অ-ব্যবস্থাকে পাল্টে ফেলার যুদ্ধে। ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ করে সুরক্ষিত বলয় থেকে এই অব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। সিলিকোসিস আক্রান্ত শ্রমিকরা এই স্তব্ধ সময়কে পেছনে ফেলে এগোতে শুরু করেছে, মিছিল ততদিন চলবে যতদিন না পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণী এই অব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলতে পারছে। সময় এসেছে পক্ষ নেওয়ার। কারণ সিলিকোসিসে আক্রান্ত শ্রমিকের মৃত্যুর দায় আমাদেরও।
লেখক চিত্রগ্রাহক ও সামাজিক কর্মী।
প্রয়াত দীপঙ্কর চক্রবর্তী ju ছাত্রদের নিয়ে এর ওপর দারুন কাজ করেছেন। মনে হয় রিসার্চ সংঘটন করেছিলেন।