লিফলেট লিখে গৃহপরিচারিকাদের ‘চুরির প্রবণতা’থেকে গৃহস্থদের সতর্ক করল কলকাতা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পথসভা ডাকল পশ্চিমবাংলা গৃহপরিচারিকা কল্যাণ সমিতি। লিখেছেন তৃষ্ণিকা ভৌমিক।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত পঞ্চসায়র থানা এলাকায় গৃহকর্ত্রী দ্বারা কিশোরী পরিচারিকা নিগ্রহের ঘটনাটি পড়ে শিউরে উঠতে হয়েছিল। রুটি ঠিক মত ফোলেনি, এই অপরাধে রুটি স্যাঁকার গরম লোহার নেট দিয়ে গায়ে ছ্যাঁকা দিয়ে শাস্তি দিয়েছে বাড়ির মালকিন। যদিও এই ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তথ্যচিত্র তৈরির খাতিরে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে, কখনো খবরের কাগজে ছাপা খবরের সূত্র ধরে ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে কিম্বা গৃহপরিচারিকাদের সংগঠিত হবার কাজে জড়িত থাকার দরুন এই ধরনের কমবেশি নৃশংস ঘটনা ঝুলিতে কম নয়। এর অধিকাংশের ক্ষেত্রেই নিগৃহীতা পরিচারিকা কোন অভিযোগ দায়ের তো দূরে থাক, পেটের দায়ে নুন্যতম প্রতিবাদটুকু করে উঠতে পারেনি। সেদিনই ফেসবুক পোস্ট মারফত কলকাতা পুলিশ কতৃক প্রকাশিত ‘জনসাধারনের উদ্দেশ্যে কলকাতা পুলিশের আবেদন’ শীর্ষক একটি লিফলেট হাতে আসে। আসন্ন উৎসবের মরসুমের জন্য সতর্ক হতে আবেদন জানানো হয়েছে এই লিফলেটে। যার ৮ থেকে ১১ নং সতর্ক বার্তায় গৃহপরিচারিকদের সম্ভাব্য চোর হিসাবে উল্লেখ করে তাদের থেকে সাবধান থাকতে বলা হয়েছে। লিফলেটের ছবি সহ পোস্টগুলি ভাইরাল হতেই গণ আন্দোলনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানায়। কলকাতা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠিতে এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলে। পশ্চিমবাংলা গৃহপরিচারিকা কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে কলকাতা পুলিশকে একটি মেল করা হয়, যার কোন উত্তর এই মুহূর্ত অব্দি এসে পৌঁছায়নি। গত সোমবার বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের দ্বারা স্বাক্ষরিত চিঠিটি লালবাজারে জমা দিতে গেলে, সেই চিঠি গ্রহণ করা হয়নি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হবার পর থেকেই কলকাতা পুলিশ রঞ্জিত শূর সহ বিভিন্ন সমাজকর্মীকে ফোন করে লিফলেট সঙ্ক্রান্ত পোস্টটি ফেসবুক থেকে সরিয়ে নিতে বলে এবং দাবি করে ওটি তারা প্রকাশ করেনি। অথচ যখনই বিধিসম্মতভাবে একই বক্তব্য পেশ করতে বলা হয়েছে তার কোন প্রত্যুত্তর মেলেনি। গৃহশ্রমিকদেরকে উদ্দেশ্য করে আপত্তিকর লিফলেট প্রকাশের প্রতিবাদে আজ বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, শিয়ালদহ, ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সামনে এক পথসভার আয়োজন করা হয়েছিল। গণ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যৌথভাবে পশ্চিমবাংলা গৃহপরিচারিকা কল্যাণ সমিতি এই পথসভা আয়োজন করে।
পথসভায় লিফলেট এর প্রতিবাদে যে চিঠিটি ডেপুটেশন হিসাবে জমা দিতে যাওয়া হয়েছিল সেটিতে উল্লিখিত দাবিগুলি পাঠ করা হয়। উল্লিখিত দাবিগুলি হল-
- এই নোটিশ প্রত্যাহার করে কলকাতা পুলিশকে গৃহকর্মীদের কাছে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে হবে।
- গৃহকর্মীদের ‘কাজের লোক’ বলে তাঁদের পেশাগত অবমাননা ও তাচ্ছিল্য দেখানো বন্ধ করতে হবে।
- গৃহকর্মীদের শ্রম ও পেশার প্রতি পুলিশকে লিখিতভাবে সম্মানজ্ঞাপন করতে হবে। এই পেশার শ্রমিকরা যে এমনিতেই সামাজিক বৈষম্য ও হিংসার শিকার, এবং পুলিশের এই নোটিশ যে তাঁদের প্রতি সামাজিক অবজ্ঞা, অবমাননা, বৈষম্য ও হিংসা আরও বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করল সেই কথা স্বীকার করে ভুল স্বীকার করতে হবে। এই ভুল-কে ঠিক করার জন্য গৃহকর্মীদের শ্রমের প্রতি সামাজিক সম্মান বাড়ানোর লক্ষ্যে উপযুক্ত সদর্থক প্রচার, বিজ্ঞাপন ও নোটিশ জারির কাজ পুলিশকে করতে হবে।
- গৃহকর্মীদের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে ও গৃহকর্মীদের দুর্বল সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থানকে বুঝে তাঁদের প্রতি নেগেটিভ স্টিরিওটাইপগুলিকে বুঝে সচেতন হতে কলকাতা পুলিশকে নিজের কর্মী বাহিনীর মধ্যে এই বিষয়ে ‘সেনসিটাইজেশন’ বা সচেতনতামূলক কর্মশালা গ্রহণ করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন গৃহকর্মী ইউনিয়নগুলির সাথে কলকাতা পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের আলোচনায় বসতে হবে।
আজকের পথসভায় বক্তব্য রাখলেন যে সমস্ত গৃহপরিচারিকার কাজে নিযুক্ত নারীরা, তাঁদের কথায় বারবার উঠে আসছিল পুলিশ সংক্রান্ত তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। যে পুলিশি ব্যবস্থা লিফলেট ছাপিয়ে, “বাড়ির কাজের লোক মানেই চোর” কার্যত এই মর্মে প্রচার চালায় আজকের সভায় বিভিন্ন বক্তব্যে ঘুরে ফিরে আসে এই পুলিশই কীভাবে সমাজের উঁচুস্তরের মানুষের থেকে টাকা খেয়ে কিম্বা তাদের পদলেহন করে বিনা কারনে এই শ্রমজীবী মানুষগুলোকে হেনস্থা করেছে। দক্ষিন ২৪ পরগণা থেকে আসা শোভাদি বলছিলেন কীভাবে যে বাড়িতে তিনি কাজই করেন না, সেই বাড়ি থেকে মোবাইল চুরি যাওয়ায় তাকে দিনের পর দিন থানা, পুলিশ, আদালত, কেসকাছারি এসবের ঝক্কি সামলে হেনস্থা হতে হয়েছে। অথচ পরে জানা যায় মোবাইল চুরির কয়েকদিনের মধ্যেই তা অন্য জায়গা থেকে উদ্ধার হয়েছে। তিনি এও বলেন “সেই সময় আমি তো এরকম কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম না। থাকলে প্রতিবাদ করতে পারতাম।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শোভাদি কাজের বাড়িতে কাজ করতে করতে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙ্গে গেছে দু’মাস ও হয়নি। কাজের বাড়ি থেকে চিকিৎসার খরচ বাবদ একটি টাকাও দেয়নি। কোনমতে সেরে ওঠা হাত নিয়ে শোভাদি কাজ করে চলেছে।
বিধাননগর বাসন্তী কলোনির চণ্ডীদি মনে করিয়ে দিলেন ২০১৬ সালে মেদিনীপুরের দাঁতন থেকে দমদমের একটি বাড়িতে সারাদিন থাকা খাওয়ার পরিবর্তে কাজ করতে আসা ১৪ বছরের বন্দনা মহাকুরের ঘটনা এবং তাতে পুলিশের ন্যক্কারজনক ভুমিকার কথা। ১৪ বছরের মেয়েটি যে কাজে ঢোকার পর থেকে কাজের বাড়ি থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি যাবার সুযোগটুকু পাইনি, তার উপর দেড় লাখ টাকা দামের গয়না চুরির অভিযোগ আনে বাড়ির মালিক। পুলিশে অভিযোগ জানালেও বন্দনা আদৌ চুরি করেছে কিনা তা নিয়ে বাড়ির মালিক বা পুলিশ কেউই মাথা ঘামায়নি। বাড়ির মালিকের মূল উদ্দেশ্য ছিল বন্দনাকে সারাজীবনের জন্য নিজের বাড়িতে বিনা পারিশ্রমিকে খাটানোর। তাই বন্দনার বাড়ির লোক ওকে ছাড়িয়ে আনার জন্য পুলিশের কাছে সাহায্য চাইলে পুলিশ ফিরিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত বন্দনার দিদি যে বস্তিতে থাকে সেই বাসন্তী কলোনির লোকজন এবং গণ আন্দোলনের কিছু কর্মী একসাথে থানায় গিয়ে চাপ সৃষ্টি করলে তবেই পুলিশ বাধ্য হয় বন্দনাকে ছাড়িয়ে আনতে। এই ঘটনায় পুলিশ যে বন্দনার কাজের বাড়ির থেকে ঘুষ নিয়ে বন্দনার বাড়ির লোকজনদের হেনস্থা করে। আধপেটা খাওয়া, আতঙ্কিত বন্দনাকে শেষমেশ উদ্ধার করা হয়। চণ্ডীদি পুলিশের উদ্দেশ্যে দাবি জানালেন প্রতিবাদী সভা থেকে, “যদি মনেই হয় আমরা চোর, চুরি করি; তাহলে পুজোর সাতদিন আমাদের ছুটির ব্যবস্থা করে দিন।” টিটাগড় থেকে আসা মাফুজাদি র কথায় উঠে আসে কীভাবে সামান্য মাটির প্রদীপ ভাঙার অজুহাতে রাতারাতি কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয় তারই পরিচিত অন্য এক গৃহ পরিচারিকাকে। গৃহ পরিচারিকদের কাজকে অসম্মানজনক কাজ হিসাবে দেখার বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় মাফুজাদি বলেন, “হ্যাঁ আমরা বাড়ির কাজ করি, কিন্তু এটা কোনোভাবেই নিচু কাজ নয়”। এছাড়াও আজকের সভায় বক্তব্য রেখেছেন গণ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মী মুনমুন বিশ্বাস, তপতী চ্যাটার্জি, রঞ্জিত শূর, কুশল দেবনাথ, আলতাফ আহমেদ প্রমুখরা। গানের সুরে লড়াইয়ের কথা বলেছেন প্রদীপ রায়, শ্যামল গায়েন ও নিশান চ্যাটার্জি। আজকের পথসভার আলোচনায় বারবার উঠে আসে আসলে এই পুলিশি ব্যবস্থা, নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা ঠিক কাদের জন্য। এই ব্যবস্থা যে আদৌ খেটে খাওয়া মানুষের কল্যাণের জন্য নয় তা সভায় উপস্থিত গৃহপরিচারিকদের বক্তব্যে বারংবার হাজির হয়েছে। তাঁরা নিজেরাই জানাচ্ছিলেন তাদের উপলব্ধির কথা, যে সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদই তাদের উপর হয়ে চলা অমানবিক ব্যবহার, অসম্মানকে রুখে দেবার একমাত্র পথ।
লেখক লিঙ্গবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।