এনআরসি, জাতীয়তাবাদ ও গণবিপন্নতা। দ্বিতীয় পর্ব : অভিবাসন ও অসমিয়া জাতীয়তাবাদ


  • September 20, 2018
  • (0 Comments)
  • 2589 Views

এপিডিআর, চন্দননগর-এর আহ্বানে ১৬ জুলাই, ২০১৮ ভূপেন সেন স্মারক বক্তৃতা। ‘এনআরসি, জাতীয়তাবাদ ও গণবিপন্নতা’ শীর্ষক সেই বক্তৃতাটির এটি পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত রূপ, যা কয়েকটি ভাগে গ্রাউন্ডজিরোতে প্রকাশিত হবে। এটি দ্বিতীয় পর্ব। লিখছেন বক্তা দেবাশিস আইচ

পৃথক প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর অসমে বাঙলা চাপিয়ে দেওয়ার নীতি অসমিয়াদের মনে বাঙালিদের উপর সন্দেহের বীজ বুনে দিয়েছিল,যা পরে জাতীয়তাবাদীদের হাতে পড়ে মস্ত আকার নেবে। পূর্ববঙ্গ-অসম রেল যোগাযোগ ঘটার পর ব্রিটিশদের উৎসাহে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মুসলমান ও নিম্নবর্ণের চাষিরা আসতে শুরু করেন অসমে। বিপুল পরিমাণে পড়ে থাকা জমি ছিল বড় কারণ।  জীবিকার কারণে নানা শ্রেণির মানুষের ভিড় বাড়তে থাকল, বাড়ল খাদ্যের চাহিদাও। এমনকি অসমিয়া জমিদার শ্রেণিও তখন চেয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের চাষিদের। “বিভেদ-বিদ্বেষ শুরু হল যখন ক্রমে এই চরবাসী কৃষক শ্রেণির এক অংশ চর ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে শুরু করলেন…”

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

 

১৮২৬ সালে অসমের ছ’শো বছরের অহম রাজত্বের অবসান ঘটে। শুরু হয় ঔপনিবেশিক শাসন। শুরু থেকে ১৮৭৩ পর্যন্ত অসম ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত। ১৮৭৪ সালে অসম প্রদেশ চিফ কমিশনারের প্রশাসনিক অধীনে আসে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-এর পরে লর্ড কার্জনের আমলে ঢাকা হয়ে উঠল পূর্ববঙ্গ ও অসমের রাজধানী। যদিও ১৯১১ সালে অসম প্রদেশের জন্য ফের চিফ কমিশনার নিযুক্ত করা হয়।

অসমে ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে বাঙালি বর্ণহিন্দুরাই ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান যন্ত্রী। অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি – মূলত সামন্তবাদী ভূস্বামী ও বর্ণহিন্দু – যা আদৌ পছন্দ করেননি। অসমে গেড়ে বসার এক দশকের মধ্যে ব্রিটিশ প্রভুরা আদালত, সরকারি কার্যালয় আর বিদ্যালয়গুলিতে বাংলা ভাষা প্রবর্তন করছিল। অসমের শিক্ষাব্যবস্থাকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। অসমে প্রথম কলেজ স্থাপিত হয়েছিল ১৯০১ সালে। বাঙালি বাবুরা সেই সময় ঠিক কতটা উস্কানি দিয়েছিল তা প্রমাণ করা কঠিন। তবে দুর্ভাগ্য অসমিয়া জাতির যে, বুদ্ধিজীবীদের বার বার নানা ভাবে প্রমাণ করতে হয়, অসমিয়া ও বাংলা দুটো স্বতন্ত্র ভাষা। সাম্রাজ্যবাদী ভাগ করে শাসন করার নীতিতে বিশ্বাসী ব্রিটিশরাজ সে কথায় কান দেয়নি। উপরন্তু, অসমের চিফ কমিশনার হেনরি হপকিনস জোরালো এবং অপমানকর ভাষায় ঘোষণা করেন, “I can come to no other conclusion that they (Assamese and Bengali) are one and all …with an admixture of local archaic or otherwise corrupted and debased words.”

এই ভাষানীতির বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার শুরু করে অসমিয়া ভাষার প্রথম পত্রিকা ‘অরুণোদয়’। মার্কিন ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা এই পত্রিকা চালু করেন। মিশনারি আর. মোফফাত মিলের নেতৃত্বে চলে ধারাবাহিক প্রচার। অসমিয়া ভাষা যে একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র ভাষা তা নানা ভাবে প্রমাণ করতে থাকে অরুণোদয়। পাশাপাশি, তৎকালীন অসমের অসমিয়া বৌদ্ধিক নেতৃত্বের তিন মূর্তি আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন, হেমচন্দ্র বরুয়া ও গুণাভিরাম বরুয়ার নিরলস লড়াইয়ের ফলে ১৮৭৩ সালের মধ্যে অসমিয়া ভাষা পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। ১৮৭৪ সালে অসম পৃথক প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেল। অসমে বাঙলা চাপিয়ে দেওয়ার এই নীতি অসমিয়াদের মনে বাঙালিদের উপর সন্দেহের বীজ বুনে দিয়েছিল। যা একদিন জাতীয়তাবাদীদের হাতে সার-জল পেয়ে মহীরুহ হবে। তবে এখানেই শেষ নয়। ১৮৭৪ সালে বাঙালি প্রধান সিলেটকে অসম প্রদেশের বাঙালি প্রধান কাছাড়ের সঙ্গে এবং বাঙালি প্রধান গোয়ালপাড়াকে নিম্ন অসমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। যুক্তি ছিল রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে এই সংযুক্তিকরণ। এর ফলে অসমে বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং সেখানকার বাঙালিরাও বাংলা মাধ্যম স্কুলের দাবি জানাতে শুরু করে। এ দাবি অযৌক্তিক ছিল না। কিন্তু গোপীনাথ বরদলৈয়ের মতো কংগ্রেস নেতারা বেসরকারি মিশ্র বিদ্যালয়ের প্রস্তাব দিলেও তা মানতে চাননি বাঙালি নেতৃত্ব। ফল, বাংলা ও অসমিয়া মাধ্যমের ভিন্ন ভিন্ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু হল।

১৯০২ সালে পূর্ববঙ্গ-অসম রেল যোগাযোগ ঘটার পর পর বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মুসলমান ও নিম্নবর্ণের চাষিরা বেশি বেশি করে আসতে শুরু করেছিলেন অসমে। যা ব্রিটিশদের উৎসাহে শুরু হয়েছিল মোটামুটি ১৮৮৫ সালের পর থেকেই। একদিকে যেমন তারা আসত ময়মনসিং, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া থেকে, অন্যদিকে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার থেকেও চাষিরা গিয়েছিলেন অসমে। বিপুল পরিমাণে পড়ে থাকা জমির টানই ছিল মস্ত কারণ। চা বাগানের পত্তন, রেললাইন, তেলের খনির কারণে আদিবাসী শ্রমিক, বিহারি ও ওড়িয়া শ্রমিক, রেলকর্মী, সরকারি অফিস-কাছারির প্রশাসনিক কর্মী-বাবুদের ভিড় যেমন বাড়তে থাকল, তেমনই বাড়ল খাদ্যের চাহিদা। তাই শুধু ইংরেজ নয়, প্রাথমিক ভাবে অসমিয়া জমিদার শ্রেণিও চেয়েছিল পূর্ববঙ্গের চাষিদের। তাদের বিপুল জমিদারিতেই শুধু নয়, চর এলাকারও বিপুল জমি পতিত হয়ে পড়ে ছিল। ১৮৯৭ সালের মার্চ মাসে আসাম এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি বাবু গুঞ্জানন বরুয়া ব্রিটিশ সরকারকে জানাচ্ছেন, অসমে ৭০.১৫ শতাংশ জমি পতিত পড়ে রয়েছে। পূর্ববঙ্গীয় চাষিদের যেন বিশেষ সুবিধায় জমি দেওয়া হয়, যাতে এই পতিত জমিতে দ্রুত সব রকমের অর্থকরী শস্য উৎপাদন করা যায়। তারও ঢের আগে একই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন অসমিয়া বুদ্ধিজীবী আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন। বিশেষ সুযোগ এই চাষিরা পেয়েছিলেন তার কারণ, ব্রহ্মপুত্রের বানভাসি চরে ধান ফলানোর বিদ্যে জানা ছিল না সেই সময়ের স্থানীয় চাষিদের। জমা জলেও যে বীজের চারা চড়চড়িয়ে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, সে বীজও হয়তো সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন চাষিরা। যার খোঁজ জানতেন না তিয়া, রাভাদের মতো আদিবাসী কিংবা অসমিয়া হিন্দু চাষিরা। শুধু ধান নয়। অর্থকরী ফসল হিসেবে পাট চাষও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

বিভেদ-বিদ্বেষ শুরু হল যখন ক্রমে এই চরবাসী কৃষক শ্রেণির এক অংশ চর ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে শুরু করলেন। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বদল ঘটছিল দ্রুত। একদিন যে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি দরিদ্র শ্রমজীবী অভিবাসীদের স্বাগত জানিয়েছিল, ক্রমে তাদের এক অংশের উগ্র জাতীয়তাবাদী রূপটি পরিষ্কার হয়ে উঠতে লাগল। বরাক উপত্যকা বাঙালিপ্রধান ছিলই, দেখা গেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে বরপেটা, ধুবড়ি, গোয়ালপাড়ার মতো জেলাগুলি বাঙালিপ্রধান হয়ে উঠল। ১৯৩১ সালের মধ্যে অসমে বাঙলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়াল ১০,৮৭,৭৭৬ বা জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ।

অসমিয়াভাষীর সংখ্যা ১৯,৮১,৩৬৯ বা ৪২ শতাংশ। অভিবাসী বিরোধী রব উঠল। অভিবাসীরা যাতে নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রিত এলাকার, অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র নদের দু’পারের এক কাল্পনিক রেখার বাইরে না যেতে পারে তার জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন তৈরি করেছিল ‘লাইন সিস্টেম’। নদীর ভাঙনে নতুন এলাকার চাষ জমির সন্ধান জরুরি ছিল। আবার প্রয়োজন ছিল স্থায়ী ঘরদোরের জন্য উঁচু ডাঙা জমি। স্থানীয়দের সঙ্গে এই নিয়েই সংঘাত তীব্র হয়। সীমানা ছাড়ালেই মুসলমান চাষিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া সহ নানা অত্যাচার বাড়তে থাকে। যে জমির লড়াই ক্রমে সাম্প্রদায়িক ও জাতিদাঙ্গার রূপ নিয়েছে এবং আজও অব্যাহত। ১৯২৮ সালে লাইন সিস্টেম-কে সহায়তা করার জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন ‘কলোনাইজেশন স্কিম’ চালু করে। ১৯৯৯ সালে অসমের এক প্রাক্তন মুখ্যসচিব বীরেন্দ্র সিং জাফা লিখছেন, “failure of both measure was evident as the immigrant settlers from East Bengal were in occupation of 37.7 % land by 1936 in Nowgong District alone.”

১৯২১ থেকে ১৯৩১ এই দশ বছরে নগাঁও জেলায় অভিবাসীদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় তিন লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ। কিন্তু, এ কথা বলা যাবে না এই অভিবাসীরা বিদেশি কিংবা অনুপ্রবেশকারী। অন্যদিকে, কোনও কোনও ইংরেজ প্রশাসক এই প্রব্রজনকে খুবই খারাপ চোখে দেখা শুরু করেছিলেন। যেমন, ১৯৩১ সালের সেন্সাস কমিশনার সি এস মুলেন, তিনি তাঁর রিপোর্টে লিখছেন (ভাষার ব্যবহার লক্ষ করবেন), “The immigrant army has almost completed the conquest of Nowgong. The Barpeta sub-division of Kamrup has fallen to their attack and Darang is being invaded. Sibsagar has so far escaped completely but a few thousand Mymensinghias in North Lakhimpur are at outpost which may, during next decades prove to be vulnerable for major operations.” এই সারগর্ভ বাণী যে সাধারণের মনে গভীর ভীতির সঞ্চার করেছিল তা সহজেই অনুমেয়। ৫০ বছর পরেও আসু’র মুখে আমরা এই বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছি।

আগেই আলোচনা হচ্ছিল ‘লাইন সিস্টেম’ -এর কথা। অর্থাৎ, অসমিয়া-অভিবাসী বিভাজনের কথা। ভাষা সেই বিভাজনের আগুনে ঘি ঢালল। যখন ১৯৩৬ সালে পশ্চিম গোয়ালপাড়ার কৃষক নেতা মতিয়ুর রহমান মিয়াঁ অসম বিধানসভায় ঘোষণা করলেন, “আমরা বাঙালি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।… বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি, অসমিয়া ভাষা আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের সন্তানদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়, আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত হই, তবে তা আমাদের সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষা থেকে বঞ্চিত করার সমতুল্য হবে।” মতিয়ুর রহমানের এই বক্তব্য আসলে বাঙালি অর্থাৎ শিক্ষিত উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি। এর আগেই রব উঠতে শুরু করে সিলেট ও অন্যান্য বাঙালি =প্রধান অঞ্চল অসম থেকে ছেঁটে ফেলার। ১৯২৭ সালে অসম সাহিত্য সভা’র বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তরুণ রাম ফুকন বলেছিলেন, “আমরা অসমিয়ারা ভারতীয়দের মধ্যে এক স্বতন্ত্র জাতি। যদিও আমাদের ভাষার ভিত্তি সংস্কৃত, তবু স্বতন্ত্র ভাষা। একটি উদীয়মান জাতি তার জীবনী শক্তি দেখায় অন্যান্যদের উপর প্রাধান্য বিস্তার ক’রে। দুর্ভাগ্য, আমাদের ক্ষেত্রে তা অন্যরকম। আমরা শুধু নির্ভরশীল নই, আমাদের প্রতিবেশী (বাঙালি) আমাদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে গিলে খেতে চাইছে। অসমিয়া ভাইয়েরা বর্তমান পরিস্থিতিকে বুঝতে গেলে আপনাদের অতীত গৌরবের প্রতিফলনে দেখতে হবে।” কংগ্রেস নেতা ও সুলেখক অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী মনে করতেন অসমের উপর অসমিয়াদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। তাঁর বক্তব্য ছিল, [Assamese to] “ensure full control…over Assam’s land and natural resources, agriculture, commerce and industry, trade, employment, language and literature, culture and ethos.” এই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের লড়াই আজও লড়ছেন জাতীয়তাবাদীরা।

শুধু জাতিগত ভাবে বাঙালির সঙ্গে সংঘর্ষে না নেমে, অসমিয়া বুদ্ধিজীবীরা ভাষার প্রশ্নে শিক্ষায়দীক্ষায় অপেক্ষাকৃত ভাবে পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলমানদের অন্য পথে মন জয়ের চেষ্টা শুরু করলেন। সে হল সাম্প্রদায়িক পথ। ১৯৩১ সালে অসম সাহিত্য সভার বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী অভিবাসী মুসলমানদের উদ্দেশে বললেন, “ময়মনসিং থেকে আসা অভিবাসীদের আমি বলতে চাই তারা আর বাঙালি নয়, অসমিয়া হয়ে গিয়েছেন। এই প্রদেশের আনন্দ, ব্যথা এবং সমৃদ্ধি ও অধঃপতনের তাঁরা সমান সমান অংশীদার। তাঁদের স্থানীয় ভাষা শেখা উচিত এবং তাঁরা শিখছেন। বর্তমানে বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁদের ভাষার মিল শূন্য। বড় কথা যে, মূল বাংলা ভাষা থেকে তাঁদের দূরত্ব অনেকখানি। অতএব আমরা তাঁদের স্বাগত জানাচ্ছি। তারা যোগ দিক অসমিয়া সংস্কৃতি ও জাতির উন্নয়নে তারা তাঁদের অবদান রাখুক।” সমস্যাটি এখানেই যে, অসমিয়া না-হয়েও যে, বাঙালি, মুসলমান, জনজাতিরাও অসম ‘প্রদেশের আনন্দ, ব্যথা এবং সমৃদ্ধি ও অধঃপতনের…সমান সমান অংশীদার’ হতে পারেন এবং হয়েছেনও – এই সারসত্যটি জাতীয়তাবাদীরা বুঝতে চায়নি। আজও চায় না। মূল আলোচনায় ফিরি।

সাতচল্লিশে দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সিলেটের প্রধান অংশ গণভোটের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকেই বেছে নিয়েছিল। অসমিয়া কংগ্রেস নেতৃত্ব তাই চাইছিলেন। তাঁদের খুশি ধরা পড়ে স্বাধীনতার পর অসম বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে। রাজ্যপাল স্যার আকবর হায়দরি যখন বলেই ফেলেন, “The natives of Assam are now masters of their own house…the Bengalee has no longer the power, even if he had the will, to impose anything on the people of these Hills and Valleys which constitutes Assam. The basis of such feelings against him as exists is fear, but now there is no cause of fear.” পাশাপাশি, মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ তৎকালীন অসমের রাজধানী খাসি পাহাড়ের শিলং-এ দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন, ‘অসম অসমিয়াদের জন্য।’ অথচ এ কথা বিস্মৃত হয়ে ১৯৪৭ -এর অসম হয়ে দাঁড়ালো মণিপুর ও ত্রিপুরা বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ উত্তর-পূর্ব। অর্থাৎ, খাসি, গারো, নাগা, মিজো, অরুণাচলীরা। তাঁরা কেউ অসমিয়া নন। এর ফল ভালো হয়নি। সে কথায় পরে আসছি। অসমের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সুজিৎ চৌধুরী (‘বরাক উপত্যকার একষট্টি সালের ভাষা আন্দোলন: স্থানীয় রাজনীতির সদর-অন্দর’) ১৯৪৮ সালে ২৮ মে জারি হওয়া বরদলৈ সরকারের একটি নির্দেশের উল্লেখ করেছেন, “The government desires to draw your (Deputy Commissioner) personal attention with regard to following non-resident population of the district. These people are not qualified to be voters. They may be staying with friends, relations or as refugees or labourers. Great caution will be necessary on part of your staff to see not a single individual of these class creep into the electoral roll by any chance.” বুঝতে অসুবিধা হয় না কাদের কথা বলছেন বরদলৈ। আর এই বক্তব্য তো ১৯৫১-র জনগণনা এবং নাগরিক পঞ্জি তৈরির মাত্র আড়াই বছর আগের নির্দেশ। সজল নাগের বক্তব্যটি এই নির্দেশের সঙ্গে আর একবার মিলিয়ে পড়ুন।

১৯৫১’র জনগণনায় গোয়ালপাড়া জেলায় দেখা গেল এক চমকপ্রদ ছবি। অসমিয়াভাষীর সংখ্যা ১৯৩১ সালে ছিল ১,৬১,১৭৯। ১৯২১ সালের তুলনায় বৃদ্ধি ১৬.১১ শতাংশ। ১৯৫১ সালের জনগণনায় তা গিয়ে দাঁড়াল ৬,৮৭,০২৭। অর্থাৎ, ১৯৩১ সালের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছিল ৩২৬.২৫ শতাংশ। আর এই সময় বাংলাভাষীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। ১৯৩১ সালে গোয়ালপাড়ায় বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল ৪,৭৬,৪৩৩ জন। ১৯৫১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১,৯৩,৩৭৯ জনে। অর্থাৎ, পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় শতাংশের পার্থক্য -৫৯.৪১। আর সমগ্র অসমে ১৯৫১ সালে অসমিয়াভাষীর শতাংশের হার গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৫৬.২৯ শতাংশ। ১৯৩১ সালের তুলনায় যে বৃদ্ধির হারের পার্থক্য ছিল ১৪৪.৫২ শতাংশ। বাংলাভাষীর সংখ্যাও কমেছিল অস্বাভাবিক হারেই। ১৯৩১ সালে যেখানে বাংলাভাষীর শতকরা হার ছিল ২৭.৫৬ শতাংশ, সেখানে ১৯৫১ সালে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১৯.৬৪ শতাংশে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেলেও ভাষার প্রশ্নে রুখে দাঁড়িয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান। যার ফলশ্রুতি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষার জন্য জান কবুল করে দিয়েছিলেন ঢাকার ছাত্র-যুব-বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষ। আর তার একবছর আগে ১৯৫১ সালের জনগণনায় নিজেদের অসমিয়াভাষী হিসেবে পরিচয় দিতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই সাবেক পূর্ববঙ্গের ময়মনসিং, বগুরার থেকে আসা বাঙালি মুসলমান। দিতে বাধ্য হয়েছিলেন জানের ভয়ে, জমি-জীবিকা হারানোর ভয়ে। চর-চাপরি মুসলমানের পাশে সেদিন কেউ ছিল না। নিজেদের হাতে গড়া চরের বহু বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বা অসমিয়া মাধ্যমে বদলে ফেলা হয়েছিল। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে মৌলানা ভাসানি’র মতো কৃষক নেতা সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা বাংলাভাষার জন্যই লড়াই শুরু করেছিলেন। কিন্ত, ফেলে রেখে যাওয়া মুসলমানদের পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন অসমিয়া ভাষা গ্রহণ করতে। বোধহয় বুঝে গিয়েছিলেন এই মানুষগুলোর আর ‘বাঙালি’ হওয়া হবে না, ‘মুসলমান’ পরিচয়েই বাঁচতে হবে। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কোনও বাঙালি (পড়ুন হিন্দু বাঙালি) নেই। আর একথাও তো ঠিক হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার তাদের দেশ ছাড়ার এক অন্যতম বড় কারণ। তার সঙ্গে যদি থাকে বিনি পয়সায় জোড়া বলদ, লাঙল পাওয়ার সুযোগ এবং তিন বছর খাজনাবিহীন জমি পত্তনের অধিকার। তবে সে সুযোগ ছাড়ে ক’জনা। ট্রেনে, স্টিমারের যাওয়ার জন্য পাঁচ টাকার ‘ফ্যামিলি টিকিট’-এর বন্দোবস্ত ছিল। শুধু বাঙালি পরিচয়টি লোপ পেয়ে গেল। পাশাপাশি, আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ অসমের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্যার সৈয়দ মহ. সাদুল্লা। সাদুল্লা ছিলেন মুসলিম লিগ নেতা। ১৯৪১ সালে তিনি অভিবাসীদের জন্য ল্যান্ড সেটেলমেন্ট নীতি ঘোষণা করেন। যার অর্থ অভিবাসীরা অসমের যে কোনো প্রান্তে পাঁচ জনের পরিবারের জন্য ২০ বিঘা জমি পেতে পারে কিন্তু তা কখনোই ৩০ বিঘার বেশি হবে না। চার বছর পর তিনি মহ. আলি জিন্নার প্রধান সহকারী লিয়াকত আলি খানকে লিখছেন, “In the four lower districts of Assam valley (Goalpara, Dhubri, Kamrup, Naogaon) these Bengali immigrant Muslims have quadrupled the Muslim population during last 20 years.” প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লার স্লোগান ছিল, ‘গ্রো মোর ফুড’। বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইংরেজের বিশ্বাসযোগ্য মিত্র হিসেবেই নাকি এই অধিক খাদ্য উৎপাদনের স্লোগান দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল অবশ্য আদৌ খুশি হননি। তিনি কটাক্ষ করেন এই বলে যে ‘গ্রো মোর ফুড’-এর নামে সরকারি জমিতে ‘গ্রো মোর মুসলিম’ নীতি চলছে। গোপীনাথ বরদলৈ নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের সঙ্গেও রীতিমতো রাজনৈতিক দ্বৈরথ শুরু হয়। ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব ছিল পূর্ব বাংলা বা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হোক অসম। স্যার সাদুল্লারও ইচ্ছে ছিল তাই। অবশ্য তা হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না। আজও অসমে বাঙালি বললে হিন্দু বাঙালি বোঝায়। মুসলমানরা ভাষাহীন, ভূমি পরিচয়হীন, জাতি পরিচয়হীন মুসলমান রয়ে গেল। অসমের জাতি তালিকাতেও তারা মুসলমান।

এর পরও, ১৯৫১’র পরেও নিজ দেশে সংখ্যালঘু হওয়ার অমূলক ভয় কাটল না অসমিয়াদের। অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র প্রধান ভাষা করার দাবি ক্রমে জোরালো হতে লাগল। ফলশ্রুতি ১৯ মে ১৯৬১। ১৮৬০ সালের ২৩ জুলাই শিলচরে ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলন’ দাবি জানায় অসমকে বহু ভাষাভাষী রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করা হোক। তবু, অসমিয়াকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষোভ দেখা দেয়। বরাক উপত্যকার কংগ্রেস বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস ও মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী প্রতিবাদে বিধানসভার কক্ষ ত্যাগ করেন। প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬১ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে হরতাল, পদযাত্রা, অরন্ধন কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। ১৯ মে ছিল সর্বাত্মক ধর্মঘট। ধর্মঘটকারী শত শত মানুষ শিলচর স্টেশনে রেললাইন অবরোধ করেন। এই নিরস্ত্র সত্যাগ্রহে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। মৃত্যু হয় ১১ জনের। মাতৃভাষার জন্য তাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন। একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়াকে মেনে নেয়নি বোড়ো, খাসি, গারো, নাগা, মিজোরাও। ওই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের মাত্র ১০ মাস আগে ২ জুলাই ১৯৬০, শিলচরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘অল আসাম নন-আসামিজ ল্যাংগুয়েজ কনফারেন্স’। বাঙালিদের সঙ্গে মিশল জনজাতি গোষ্ঠীগুলি। সম্মেলনের প্রস্তাবনায় বলা হল “The conference of the Non-Assamese speaking people of Assam strongly opposes the move to impose Assamese as the official language for the state of Assam and that the status quo based on the intrinsically multilingual character of the state must be maintained for the peace and security of the eastern region of India.”

ফলশ্রুতি, ভারতের সর্ববৃহৎ রাজ্যে ধরল ভাঙন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৮৭’র মধ্যে প্রথমে ইউনিয়ন টেরিটরি, পরে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পেল নাগাল্যান্ড (১৯৬৩), মেঘালয় (১৯৭১), মিজোরাম (১৯৮৬) ও ‘নেফা’ হল অরুণাচল প্রদেশ (১৯৮৭)। এই তো দু’দশক আগে, ১৯৯৬ সালে গুয়াহাটির সার্কিট হাউসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার পূর্ণ সাংমা বলেই ফেললেন, “আমরা সবাই অসমিয়া বলতাম, এখনও পারি। কিন্তু আমরা অসমিয়া নই। সুতরাং অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়া মানব না। এ জন্যই অসম ভেঙে গিয়েছে।” অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদীদের জনজাতিরা আজও কী চোখে দেখে তা দ্য শিলং টাইমস-এর (২২ জানুয়ারি, ২০১০) এক প্রধান সম্পাদকীয় স্তম্ভে স্পষ্ট।

“For Meghalaya, January 21st is what Independence Day is to the rest of India. It was a day when the hill tribes (Khasis, Garos) were given mandate to carve out their own destiny by way of a separate state called Meghalaya. The tribes collectively fought Assamese chauvinism which was manifested in the imposition of the Assamese language as the lingua franca. The movement, popularly known as Hill State Movement was without rancour or bloodshed.”

এখানেই শেষ নয়। ইতিহাস খুঁড়লে এমন অনেক কাহিনির অবতারণা করা যায়। কিন্তু আমাদের সময় হয়েছে বর্তমানে ফেরার। ঘটমান বর্তমান।

 

তৃতীয় পর্বটি পড়বার জন্য এখানে ক্লিক করুন।

 

ছবি সৌজন্যে – এপিডিআর, চন্দননগর

লেখক স্বতন্ত্র সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী।

Share this
Leave a Comment