আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের আনুষ্ঠানিক গোড়াপত্তন ১৯শতকের শেষে স্পেন-মার্কিন যুদ্ধ। যুদ্ধশেষে চুক্তি অনুযায়ী বিক্রি হয়ে যায় গোটা একটা দেশ, ফিলিপিন্স, মাত্র ২০মিলিয়ন ডলারে। আমেরিকার প্রভুত্ব অস্বীকার করার অপরাধে ১৮৯৯ সনে আমেরিকা প্রথম ফিলিপিনীয় প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সঙ্ঘটিত হয় ফিলিপিন্স গণহত্যা। ১৮৯৯–১৯০৫ এর মধ্যে নিহতের সংখ্যা প্রায় ১.৪ মিলিয়ন। মার্কিন সাম্রাজ্যের রক্তাক্ত ইতিহাস ও বর্তমানের জন্মলগ্ন নিয়ে লিখছেন সিদ্ধার্থ বসু।
১৮৯০ এর দশক। প্রায় পুরোটা পৃথিবী জার্মানি, ফ্রান্স আর গ্রেট ব্রিটেনের উপনিবেশ। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের একচেটিয়া দুনিয়ায় প্রথম পা রাখল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুরু হল স্পেন-মার্কিন যুদ্ধ, যার পরিণতিতে প্যারিসের চুক্তি স্বাক্ষর হল ১৮৯৮ সালে। ফিলিপাইন্স, প্যারিসের চুক্তি অনুযায়ী, স্পেন থেকে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করার ফলশ্রুতিতে ১৮৯৯ এর ৪ ফেব্রুয়ারি ২য় ম্যানিলার যুদ্ধ শুরু হয়। মনে রাখতে হবে যে ফিলিপিন্স হস্তান্তরের জন্য ইউএস সরকার স্পেনের সঙ্গে ২০মিলিয়ন ডলারে রফা করেছিল। ২ জুন ফিলিপিন্স সরকারিভাবে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
এ যুদ্ধ সম্পর্কে শোনা যায় যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ম্যাকিনলে নাকি হোয়াইট হাউসে প্রার্থনায় বসেছিলেন। এমন সময় হঠাৎ তাঁর মাথায় আসে যে স্পেনকে ফিলিপিন্স ফিরিয়ে দেওয়া নেহাতই কাপুরুষের কাজ হবে। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি দাঁড়ায়, ব্যবসায়িক অসুবিধার জন্য ফ্রান্স বা জার্মানির সঙ্গেও ফিলিপিন্সকে জুড়তে দেওয়া যায় না। আর, নিজেদের শাসনভার তুলে নেওয়ার জন্য তো তারা যোগ্যই নয়। অতএব তিনি ঠিক করলেন যে গোটা ফিলিপিন্সকে আমেরিকাই নেবে (সে অবধি শুধু ম্যানিলাই তাদের দখলে ছিল): অধিবাসীদের শিক্ষিত করবে ও খ্রিস্টীয় ধর্মে দীক্ষা দেবে। অতঃপর সেই মোতাবেক ১৮৯৯ সনে আমেরিকা প্রথম ফিলিপিনীয় প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে–শুধুই শিক্ষা-দীক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে–যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারপর যা ঘটে, তাকে যুদ্ধের চাইতে হত্যাকাণ্ড বলাই সমীচীন হবে। উন্নততর এবং বহুল সংখ্যাধিক মার্কিন মারণাস্ত্রের সামনে ফিলিপিন্সের কোনো সুযোগই ছিল না।
ই. আহমেদের The Theory and Fallacies of Counter Insurgency তে পাওয়া যায়, আমেরিকা-ফিলিপিন্স সংঘাত জনসংখ্যার নিরিখে এশিয়ার মাটিতে শ্বেতাঙ্গদের ঘটানো বৃহত্তম রক্তক্ষয়ী ঔপনিবেশিক যুদ্ধ। প্রায় ৩০ লক্ষ লোক এতে মারা যায়। ফিলিপাইন ঐতিহাসিক লুজিভিমিণ্ডা ফ্যান্সিস্কোর মতে ১৮৯৯–১৯০৫ এর মধ্যে নিহতের সংখ্যা প্রায় ১.৪ মিলিয়ন। তাও মার্কিন শাসনের প্রথম দুই দশকে আইনের শাসন বজায় রাখার জন্য সংঘটিত খুনগুলো এ তালিকায় নেই। এমনকি ফিলিপাইন মুসলিম বা মরোদের নৃশংস হত্যালীলাও এতে ধরা হয়নি।
ফিলিপিন্স গণহত্যার কথা আজকের দিনের ফিলিপিনোরা নিজেরাই প্রায় কেউ জানে না। ঘাতকরা তাদের হাতে লেখা ইতিহাসে সে কেলেঙ্কারির কথা বিলকুল চেপে গিয়েছে। এমনকি, ফিলিপাইন জনগণনার ফলাফলে এসময় কোনো উল্লেখযোগ্য পতন লক্ষ করা যায় না কেন, সে প্রশ্নও ওঠে। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে ফিলিপিন্সের বহু মানুষ আজকের সময়েও আদমশুমারের রাডারে ধরা পড়ে না। সেখানে ১৮৯০-১৯০০ নাগাদ পরিস্থিতি নিশ্চয়ই আরো অনেক ঘোরালো থেকে থাকবে। তার ওপরে স্প্যানিস জনগণনায় ইগোরোটস, ইটাস, লুমাডস এবং মরো প্রজাতির মানুষদের গোনাই হতো না। আর মার্কিনরা তাদের নিজেদের আদমশুমারিতে এক পয়েন্ট চার মিলিয়নের ওপর জনসংখ্যার আকস্মিক পতনকে – খুব স্বাভাবিকভাবেই – প্রকাশ করতে চায় নি।
১৯০১ এর ফিলাডেলফিয়া লেজারে ম্যানিলার প্রতিবেদক লেখেন
আমাদের লোকেরা নির্বিচারে রক্ত ঝরাচ্ছে; পুরুষ, মহিলা, শিশু, জেলবন্দী মানুষজন, সক্রিয় বিপ্লবী কর্মী এবং দশ বছরের ওপর বয়সী যে কোনো সন্দেহভাজন লোকেদের কুকুরের মতো খুন করা হচ্ছে। মানুষকে কথা বলানোর জন্যে মুখ দিয়ে নুন জল পাম্প করছে আমাদের সৈন্যরা। শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করা বন্ধুদের হাত তোলা অবস্থাতেই সাঁকোর ওপর দাঁড় করিয়ে এক এক করে গুলি করে মারা হচ্ছে, যাতে তারা জীবিত সহনাগরিকদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কুশলী সমর্থকদের পক্ষ থেকে জন্ম নেয় এক অভিনব লব্জ: ‘লিটল ব্রাউন ব্রাদার’–যে নামে তারা শোষিত ও বিধ্বস্ত ফিলিপিনোদের ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। যাদের পিছিয়ে থাকা জীবন ও অনাধুনিক অন্ধকার সভ্যতাকে উন্নতির আলোয় নিয়ে আসার মহৎ দায় নিয়েছে তখন আমেরিকানরা। বিশ্রুত কথাকার রুডিয়ার্ড কিপ্লিং ‘দ্য হোয়াইট ম্যান্স বার্ডেন’ নামে এক বীভৎস কবিতা লিখে রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টকে উৎসর্গ করেন। সে কবিতার ছত্রে ছত্রে সাদা মার্কিনদের মহান আত্মত্যাগের জয়গান। যে আত্মত্যাগ তারা করছে দুর্ভাগা আর অকৃতজ্ঞ, অশিক্ষা আর অজ্ঞতার বিবরে উচ্ছন্ন ফিলিপিনোদের সত্যিকারের মানুষের জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকারে, তা সে যতই রক্তক্ষয়ী অসম যুদ্ধের বিনিময়ে হোক না।
প্রথম দফার যুদ্ধে অ্যাডমিরাল ডিউই পাসিগ নদীর ওপর থেকে পাঁচশো পাউন্ড শেল ছোঁড়েন। ফিলিপাইন লাশের স্তূপ দিয়ে মার্কিনীরা প্রতিরক্ষা প্রাচীর তৈরী করে ফেলেছিল।
১৯০০ সালের ১৫ ই অক্টোবর সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন লেখেন
হাজার হাজার দ্বীপবাসীকে পরাজিত করে আমরা মাটিতে পুঁতে ফেলেছি; তাদের খেত খামার ধ্বংস করেছি; গ্রামগুলোকে জ্বালিয়ে দিয়েছি; স্বামীহারা অভিভাবকহীন নারী ও শিশুদের ঘরছাড়া করেছি; অসংখ্য দেশভক্তকে নির্বাসনে পাঠিয়েছি; আর বাকী দশ মিলিয়ন বাসিন্দাকে শেষ করেছি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ আত্তীকরণ’ এর মারফৎ — আমাদের নির্দয় বন্দুকবাজির নতুন পবিত্র নাম। ব্যবসায়িক সহযোগী সুলুর সুলতানের থেকে তিনশো রক্ষিতা আর প্রচুর ক্রীতদাস পেয়েছি এবং তাদের পতাকার ওপর আমাদের রক্ষকের নিশান উড়িয়ে দিয়েছি। আর এইসবের পর – সরকারি মতেই – আমরা এখন এক বিশ্বশক্তি।
মার্কিন শ্বেতাঙ্গবাহিনী এবং নির্লজ্জ মার্কিন রাজনীতিকদের সর্বজনীন অন্ধ বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে মার্ক টোয়েন আগেও সরব হয়েছেন। মার্কিন বাহিনীর ধর্ষকামী যুদ্ধাপরাধ তাকে বিচলিত করতো। জাতীয় পতাকায় তারা আর ডোরাকাটা দাগের জায়গায় – তাঁর মতে – মড়ার খুলি আর হাড় এঁকে দেওয়া উচিৎ ছিল।
ফিলিপাইন জাতীয়তাবাদীরা এই যুদ্ধকে ১৮৯৬ এ শুরু হওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী অংশ বলে মনে করত। আর মার্কিনরা এর নাম দিয়েছিল দেশদ্রোহ ও তার প্রতিকার। আমেরিকার লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব ফিলিপাইন জনসংখ্যাকে নিকেশ করার দিকে। গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে তো তারা দিয়েছিলই, তার ওপরে বহু গ্রামে তারা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানিয়েছিল যেগুলোকে তারা বলতো রিকনসেনট্রাডো। এগুলোতে তারা চারিদিকে আগুন জ্বালাতো। আর তারপর ওয়াচ টাওয়ার বসিয়ে নজর করতো: কাউকে আগুনের বাইরে বেরোতে দেখলেই গুলি করা হত। এই ক্যাম্পগুলো ছিল রোগ ব্যাধির আস্তানা। কোথাও কোথাও মৃত্যুহার ছিল ২০% অবধি। বন্দুক ধরে লোকজনকে জেরা করা হত, আর তারপর – তারা যা উত্তরই দিক বা না দিক – গুলি করে মারা হত।
কর্পোরাল স্যাম গিলির লেখায় পাওয়া যায়
সবাইকে সাতটার মধ্যে বাড়ি ঢুকতে বলা হত এবং ঠিক একবারের বেশি কাউকে বলতে হলে তাকে গুলি করা হত। কোনো বাড়ি থেকে গুলির প্রত্যুত্তর পাওয়া গেলে পুরো এলাকা জ্বালিয়ে দেওয়া হত। ফলে অঞ্চল মোটামুটি শান্তই থাকত।
১৯০২ এর ২রা জুলাই যুদ্ধ শেষ হয়। তারপরেও অবশ্য কাতিপুনানদের নেতৃত্বে কিছু স্পেনিয় ফিলিপাইন গ্রুপ আরো কিছু বছর ধরে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে ছোটোখাটো খন্ডযুদ্ধ চালায়। এই গণহত্যার শেষে ফিলিপিন্সে খ্রীষ্টিয় ক্যাথলিক চার্চ রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা হারায় এবং সরকারী ভাষা হিসেবে সর্বক্ষেত্রে ইংরাজী স্বীকৃত হয়।
১৮৯৮ এর প্যারিসের চুক্তি মোতাবেক ফিলিপাইন্স ছাড়াও পুয়ের্তো রিকো, গুয়ামও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কবলে চলে যায়। কিউবার অস্থায়ী কর্তৃত্বও যায় তাদের অধিকারে। এরপর চলে স্পেন-মার্কিন যুদ্ধ। সম্প্রসারণবাদের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয় ইউএস সরকার। আগ্রাসী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ গিলে নিতে থাকে একের পর এক ভূখণ্ড।
লেখক একজন শিক্ষক ও সামাজিক কর্মী। সমস্ত ছবির উৎস: ব্রিটস ইন দ্য ফিলিপিন্স।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দূর হঠো। ইনকিলাব জিন্দাবাদ