বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত অবস্থান বিক্ষোভ


  • September 10, 2018
  • (0 Comments)
  • 8331 Views

বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান দুর্নীতি ও বেনিয়মের বিরুদ্ধে সরব হতে বাধ্য হয়েছেন। কর্তৃপক্ষের অনাচারের সাথে যোগ হয়েছে ধামাধারী কিছু ছাত্রছাত্রীর নির্ভয়ে ছড়ি ঘোরানো। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলার ভিত্তিতে গ্রাউন্ডজিরো থেকে এই রিপোর্টটি প্রকাশ করা হল। নীচে ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা প্রকাশিত লিফলেটে রয়েছে তাঁদের এই সিদ্ধান্তের পিছনে থাকা নানা গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

 

বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রাজ্য তথা দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বলে পরিচিত। অথচ গত কয়েকমাস ধরে এখানে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক পরিসর – এমনটাই জানাচ্ছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশের ছাত্রছাত্রীরা। তাঁরা কর্তৃপক্ষের ও তাঁদের ধামাধারী ছাত্রছাত্রীদের স্বৈরাচারী ব্যবহারের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছেন। তাঁদের মতে, বিশেষত ডীন অফ স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার (ডিএসডব্লিউ) বা ছাত্রকল্যাণ প্রতিনিধি প্রফেসর গৌতম চক্রবর্তী ও ডীন, ফ্যাকাল্টি অফ এগ্রিকালচার প্রফেসর শ্রীকান্ত দাসের প্রত্যক্ষ মদতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে এই স্বৈরাচারী রাজ শুরু হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা কোথায় বসবেন, কি জাতীয় সাংস্কৃতিক কাজকর্ম করবেন, বিশেষত প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা – হোস্টেলে বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সিনিয়রদের সাথে বসে আড্ডা মারবেন কি না, সবই ছাত্র কল্যাণের ছুতোয় ঠিক করে দিচ্ছেন ডিএসডব্লিউ। ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না এই অবস্থার শিকার বহু ছাত্রছাত্রী। “ক্যাম্পাসের এই বদ্ধ পরিবেশ কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়কে উৎকর্ষতার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠতে দেবে না” বলে মনে করছেন তাঁরা।

৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় বর্ষের কিছু ছাত্র কর্তৃপক্ষের মদতপুষ্ট তৃতীয় বর্ষের কয়েকজন ছাত্রের সাথে বিষয়টি নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে আলোচনা করতে গেলে বিনা প্ররোচনায় তাঁদের মারধর করা হয়। আহত ছাত্ররা জানান, এই মারধরে যোগ দেন এমএসসি কোর্সে পঠনরত আরও কিছু “দালাল” ছাত্র। ডীন প্রফেসর দাসের দাখিল করা অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো তদন্ত ছাড়াই ক্যাম্পাসে পুলিশ আসে এবং আক্রান্ত ছাত্রদের নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে উল্টে তাঁদের শাসানো হয়। গুরুতর জখম অবস্থায় দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রকে কল্যাণীর জেএনএম মেডিকাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন সকালে সম্পূর্ণ প্ররোচনাবিহীন ভাবে ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকানোর অভিযোগে ডীন ও ডিএসডব্লিউ-এর অপসারণের জন্য ছাত্রছাত্রীরা ভিসিকে অনুরোধ জানান। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী ভিসি এই অনুরোধে বিশেষ কর্ণপাত করেননি।

ক্যাম্পাসে কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের সম্মিলিত শাসন

ইতিমধ্যে আক্রান্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে আনা হয় মিথ্যা অভিযোগ – প্রথম বর্ষের ছাত্রদের উপর ‘র‍্যাগিং’-এর। ছাত্রছাত্রীরা ডীন/এগ্রিকালচার ও ডিএসডব্লিউ-এর অপসারণ এর দাবিতে ভিসির দপ্তরের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে বসবার সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে মূলত দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্রীদের এই অবস্থান বিক্ষোভে সামিল হতে না দেওয়ার উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে লেডিস হোস্টেলের গেটে চাবি লাগিয়ে দেওয়া হয়, ছাত্রীদের পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গ তুলে প্রকাশ্যে বিভিন্নভাবে তাঁদের অপমান করা হয় এবং বিশেষ ভাবে কয়েকজন প্রতিবাদী ছাত্রীকে এমএসসি অ্যাডমিশন আটকে দেওয়া বা হোস্টেলের বোর্ডারশিপ আটকে দেওয়ার হুমকি থেকে শুরু করে নানা ভাবে ভয় দেখান হয়। প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রারী জানান, ওই রাতেই কর্তৃপক্ষের ধামাধারী কিছু ছাত্রী (যাঁদের হোস্টেলে বন্ধ রাখার প্রয়োজন পড়েনি) আন্দোলনকারী ছাত্রদের নামে ‘ইভ টিজিং’-এর মিথ্যা অভিযোগ আনেন। এই অভিযোগের দায়ে কিছু ছাত্র মারও খান। তা সত্ত্বেও অবস্থান বিক্ষোভ বন্ধ করা যায়নি।

বিসিকেভি-র আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের প্রকাশিত লিফলেট

৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের দাবিতে অনড় থাকেন। উপরন্তু এবার তাঁরা লেডিস হোস্টেলের দুর্নীতিপরায়ণ মেস সেক্রেটারিকে বরখাস্ত করার দাবিও তোলেন। দুপুর ১২টা নাগাদ কয়েকজন আন্দোলনরত ছাত্রীকে শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করা হয়, দু’জন ছাত্রী জখম হন এবং একজনকে জেএনএম হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। ভিসি এরপরেও কোনো আলোচনায় যেতে রাজি হন না, এবং ছাত্রদের ‘স্পয়েল্ট চাইল্ড’ বলে, তাঁরা ‘দায়িত্বহীনে’র মত আচরণ করার কারণেই মার খেয়েছেন – এইজাতীয় কথা বলে হেয় করেন ।

এসব সত্ত্বেও টানা অবস্থান বিক্ষোভ চলতে থাকে। বিক্ষোভ চলাকালীন কয়েকজন ছাত্র অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব চিকিৎসকরা এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করেননি বলে ছাত্ররা জানিয়েছেন। শনিবার সকালে ভিসি তাঁর দপ্তর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে ছাত্র কল্যাণ দপ্তর সমেত সামগ্রিক ভাবে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষাই করা হয়ে আসছে। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় খুনের হুমকি ও জঘন্য কুৎসা রটানোর (বিশেষত মেয়েদের নামে, যার ভিতর – ছাত্রীরা জানিয়েছেন – রয়েছে প্রতিবাদী মেয়েদের রাতপোশাক পরিহিত ভিডিও প্রচারের হুমকিও) পাশাপাশি এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক রঙে রাঙানোর চেষ্টা জারি রয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় দুর্নাম রটানোর প্রয়াস

‘অ্যান্টি-তৃণমূল’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হলেও ছাত্রছাত্রীরা এই আন্দোলনকে সেভাবে দেখতে চান না। তাঁদের মতে, এটি একটি “সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলন”। প্রায় ১০০ ঘণ্টার কাছাকাছি সময় ধরে চলছে তাঁদের অবস্থান। দাবি পূরণ না হওয়া অব্দি তাঁরা পিছিয়ে আসতে রাজি নন মোটেই।

Share this
Leave a Comment