এই উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদী ও মুসলমান মৌলবাদীদের প্রচারে ইতিহাসের এক ধরনের সহজপাচ্য সহজপাঠই বরাবর গুরুত্ব পেয়ে এসেছে যার সহজ কারণ হল শত্রুপক্ষকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে লোক জড়ো করার রাজনীতিতে এর কাটতি প্রচুর। বলাই বাহুল্য যে ইতিহাসের এই সহজপাঠের সঙ্গে ইতিহাসের পাথুরে সাবুদের দুস্তর ফারাক। কাজেই ১৯৪৬-এর একচোখো ইতিহাসে গোপাল পাঁঠা যদি কোনও ভয়ঙ্কর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গের রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠেন তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। লিখছেন প্রসিত দাস।
১৬ আগস্ট দিনটি হিন্দু সংহতি নামক সংগঠনটি গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ‘উদযাপন’ করে আসছে ‘১৯৪৬–৪৭–এ পশ্চিমবঙ্গের রক্ষাকর্তা হিন্দু বীর’ গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের স্মরণে । এই দিনটিতে সংগঠনটি কলকাতার রাস্তায় হাজার হাজার মানুষের মিছিল (আজ্ঞে হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই) করে থাকে। ১৬ আগস্টের প্রচারে হিন্দু সংহতি নিজেদেরকে ‘ইতিহাসের বামপন্থী বিকৃতি সংশোধনে ব্রতী’ বলে উল্লেখও করে থাকে। মজার ব্যাপার হল, হিন্দু সংহতির ১৬ আগস্টের মিছিলে ‘গোপাল মুখার্জি লাল সেলাম’ স্লোগান উঠতেও শোনা গেছে।
পারিবারিক মালিকানাধীন পাঁঠার মাংসের দোকানটির সূত্রে কলকাত্তাইয়া কিংবদন্তিতে ‘গোপাল পাঁঠা’ নামে সুপরিচিত গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন বৌবাজারের মলঙ্গা লেনের বাসিন্দা। বিপ্লবী অনুকূল চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের এই ভ্রাতুস্পুত্রটি বিধান রায় ও সুভাষচন্দ্র উভয়েরই অনুরাগী ছিলেন, যদিও কংগ্রেসি রাজনীতির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না। যেমন জোর দিয়ে বলা যায় না যে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট গোপাল মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সংগঠিত ভারতীয় জাতীয় বাহিনী–র ভূমিকার মধ্যে কতদূর সাম্প্রদায়িকতা ছিল, আর কতটা ছিল এলাকাগত রক্ষণের উপাদান। ’৪৬-’৪৭ সালের দাঙ্গায় ব্যবহার হওয়া পয়েন্ট চব্বিশ বোরের রিভলভারগুলি গোপাল মুখোপাধ্যায় জোগাড় করেছিলেন ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় ঘাঁটি–গাড়া মার্কিন সৈন্যদের কাছ থেকে। তাঁর নিজের কথায় এক বোতল হুইস্কি কিংবা সামান্য কিছু টাকার মুল্যে এই জাতীয় অস্ত্র সে আমলের কলকাতায় দিব্যি সুলভ ছিল। আর রাজপথে অহরহ সংঘর্ষে ও রাজনৈতিক মিটিং–মিছিলে হামেশাই উত্তপ্ত চল্লিশের দশকের কলকাতায় এই অস্ত্র মজুত ছিল নেহাতই স্বাভাবিক প্রবণতা। তাছাড়া সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘ইতিহাসের দিকে ফিরে ছেচল্লিশের দাঙ্গা’ বইটিতে লিখেছেন, ব্যবসায়িক কারণেই গোপাল মুখোপাধ্যায়কে বহু মুসলমান ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হত। সোজা কথায়, আঁকাড়া মুসলমান–বিদ্বেষী হিসেবে কোনও জন–পরিচিতি তাঁর ছিল না।
রাজনৈতিক হিংসা ও সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির বিভিন্ন বয়ানের উপাদান জোগানোর ক্ষেত্রে কলকাতায় ছেচল্লিশের দাঙ্গা ও ‘গ্রেট ক্যালক্যাটা কিলিং’ (অভিধাটি সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয় ’৪৬ সালের ১৭ আগস্ট ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম হিসেবে)-এর গুরুত্ব ও কদর দুই–ই প্রচুর। ১৯৪৬ সালের গ্রীষ্মে ক্যাবিনেট মিশন ব্রিটিশ সরকারের হাত থেকে ভারতীয় নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব নিয়ে ভারত সফরে আসে। এই উপলক্ষে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃত্বের মধ্যে একটি সাময়িক সমঝোতা হলেও সে সমঝোতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তার কারণ দু’পক্ষের পারস্পরিক সন্দেহ আর অবিশ্বাস। এখানে উল্লেখযোগ্য, ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালের ১৬ মে তারিখে ভারতের স্বাধীনতার যে প্রস্তাবটি পেশ করে সেখানে কিন্তু ঐকবদ্ধ ভারতবর্ষের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছিল, সেখানে হিন্দু–সংখ্যাগরিষ্ঠ আর মুসলমান–সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলি আলাদা ভাবে বিন্যস্ত হবে। আর পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করার জন্য কেন্দ্রীয় ভাবে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। এই হিন্দু– আর মুসলমান–সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলিকে আলাদা করার বিষয়টি কংগ্রেসি নেতৃত্বের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়, কারণ তাঁরা এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারে ও ভবিষ্যতের ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য হারানোর ভূত দেখতে পান। কংগ্রেস ও লীগ দু’পক্ষের অনড় অবস্থানের সামনে পড়ে ক্যবিনেট মিশন ১৬ জুন দ্বিতীয় আরেকটি পরিকল্পনা ঝুলি থেকে বার করে যেখানে হিন্দু–সংখ্যাগরিষ্ঠ ও মুসলমান–সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতবর্ষকে সরাসরি ভাগ করার কথা বলা হয়। আগের প্রস্তাবটিতে কংগ্রেসি নেতৃত্ব ‘খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না’ গোছের একটি অবস্থান নিয়েছিল, জুন মাসের প্রস্তাবে তারা সরাসরি বেঁকে বসে। ১০ জুন একটি বক্তৃতায় নেহরু সাফ বলেন যে একমাত্র সংবিধান–সভায় যোগ দেওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। আর এই প্রেক্ষাপটেই আসে ’৪৬–এর ১৬ আগস্ট।
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের ‘ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে’ বা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’–এর উদ্দেশ্য ছিল নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের দাবির স্বপক্ষে ঔপনিবেশিক সরকারের সামনে শক্তি–প্রদর্শন। তবে ছেচল্লিশের দাঙ্গা বিষয়ে ‘মুসলিম লীগের আক্রমণ’ ও সাধারণ হিন্দু জনতার প্রতিরোধের ছকটি বহু আগেই তামাদী হয়ে গেছে। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কর্মসূচি সম্পর্কে জিন্না সাহেবের আবেদনটি যথেষ্টই মারমুখী ছিল সন্দেহ নেই, তবে এ–কথা ভাবাটা ঠিক হবে না যে অপর পক্ষের তরফে কোনও প্রস্তুতি ছিল না। ইতিহাসবিদ জয়া চ্যাটার্জি তাঁর ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’–এ লিখেছেন, আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ মুসলিম লীগের সদস্যদের মতই হিন্দু মহাসভার স্বেচ্ছাসেবকরাও লড়াইয়ের জন্য তৈরি ছিল, তাদের অস্ত্র ছিল মূলত ছোরা আর দিশি পিস্তল। যুগান্তর দলের বিপ্লবী ও পরে বামপন্থী নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মকথা ‘বিপ্লবের সন্ধানে’–তে লিখেছেন, “…লীগ থেকে যখন ১৬ই আগস্ট হরতাল ঘোষণা করা হল, তখন হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেস মিলে ১৪ই আগস্ট দেশপ্রিয় পার্কে এক বিরাট সভা করে এক প্রস্তাব পাশ করা হল যে, এ হরতাল কিছুতেই সফল হতে দেওয়া যাবে না, … ১৬ই আগস্ট হরতাল উপলক্ষে যে দাঙ্গার সম্ভাবনা ষোল আনা, এটা সকলেই অনুভব করতে লাগল এবং দুই পক্ষই তার জন্য প্রস্তুত হল।” বস্তুত তিরিশের দশক থেকেই বাংলার নির্বাচনী রাজনীতিতে মুসলমানদের গুরুত্ব বাড়ছিল। তাছাড়া ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রীসভার আমলে প্রকাশিত ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টে বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পক্ষে জোরালো সওয়াল করা হলে জমিদারি–নির্ভর হিন্দু বাঙালি উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজে আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে আসে। এই দু’টি বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলার রাজনীতিতে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার প্রকট ও প্রচ্ছন্ন যুক্তফ্রন্ট বেশ জমে উঠেছিল। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় এরই একটি সংগঠিত চেহারা দেখা যায়।
জয়া চ্যাটার্জি তাঁর বইয়ের আরেক জায়গায় তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে লিখেছেন যে, যেখানে মুসলমান দাঙ্গাকারীদের বেশিরভাগ ছিলেন গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষজন, সেখানে দাঙ্গায় অংশ নেওয়া হিন্দু জনতার মধ্যে একটা বড় অংশ ছিল শিক্ষিত তরুণ, ছাত্র সমাজ ও মধ্যবিত্ত পেশাজীবী। আসলে ১৯৩১ সাল নাগাদই শহর কলকাতায় বসবাসকারীদের ৩১.৭০ শতাংশ আসছেন ভিন রাজ্যগুলি থেকে, আর ৩০ শতাংশ আসছেন কলকাতার বাইরের জেলাগুলি থেকে। মূলত কলকাতা ও তার আশপাশের অঞ্চলের কলকারখানাগুলিতে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য গ্রাম থেকে আগত এই জনগোষ্ঠীর শহরবাসের রোজনামচা যে খুব একটা সহজ ও সুখকর ছিল না সেকথা বলাই বাহুল্য। স্বাভাবিকভাবেই ভাষা ও ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক সত্তার শেকড় এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্টই মজবুত ছিল। ছেচল্লিশ ও তার পরেও মুসলমান শ্রমিক, কষাই, খালাসি বা ছ্যাকরা গাড়ির চালকদের শহরের রাজপথে দাঙ্গাকারীর ভূমিকায় দেখা গেছে, কিন্তু ছেচল্লিশের দাঙ্গায় হিন্দু মহাসভার তরফে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভূমিকা এ–ব্যাপারে আলাদা ভাবনার খোরাক জোগায়।
তাছাড়া ১৯৪৬–এর ১৬–১৯ আগস্টের দাঙ্গা চলাকালীন অবিভক্ত বাংলায় ক্ষমতাসীন সুরাওয়ার্দি সরকারের সাম্প্রদায়িক ভূমিকা নিয়ে নানা সময় বিস্তর কথা তোলা হয়েছে। তার মধ্যে যাথার্থও নিশ্চয়ই খানিকটা আছে। কিন্তু কোনও আড়াআড়ি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের দিক থেকে যদি সরকারের ভূমিকাকে বিচার করতেই হয় তাহলে এ–কথাও মাথায় রাখতে হবে যে সে সময়ে ৬০ লক্ষ মানুষের কলকাতা শহরে মাত্র ১২০০ সদস্যের একটি পুলিশ বাহিনী ছিল, যে–বাহিনীতে মাত্র ৬৩ জন ছিলেন ধর্মে মুসলমান। আর অফিসারদের মধ্যে একজন ডেপুটি কমিশনার ও একজন ওসি ছাড়া সকলেই ছিলেন হিন্দু। আর যদি লাশ গোনার হিসেবই করতে চাওয়া হয় তাহলে জেনে রাখা ভালো যে সুরঞ্জন দাশ সহ ছেচল্লিশের দাঙ্গা নিয়ে গবেষণা–আছে এমন সব ইতিহাসবিদই একটি বিষয়ে মোটামুটি একমত। তা হল এই দাঙ্গায় মুসলমানদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা হিন্দুদের তুলনায় ঢের বেশি। এর কারণটি কিন্তু খুব জটিল নয়। ধনী হিন্দু ও ধনী মুসলমানদের পক্ষে পিঠ বাঁচানো অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছিল (ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল), কিন্তু সামাজিক ও অন্য ধরনের নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত গরিব মানুষের পক্ষে তা সহজ ছিল না। আর ১৯৪৬ সালের কলকাতায় বসবাসকারী অধিকাংশ মুসলমানই ছিলেন দরিদ্র শ্রেণির।
এই উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদী ও মুসলমান মৌলবাদীদের প্রচারে ইতিহাসের এক ধরনের সহজপাচ্য সহজপাঠই বরাবর গুরুত্ব পেয়ে এসেছে, তার সহজ কারণ হল শত্রুপক্ষকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে লোক জড়ো করার রাজনীতিতে এর কাটতি প্রচুর। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারও তাই উদার হস্তে পাঠ্যক্রম থেকে এটা–সেটা বাদ দিতে উদ্যোগী হয়েছে। বলাই বাহুল্য যে ইতিহাসের এই সহজপাঠের সঙ্গে ইতিহাসের পাথুরে সাবুদের দুস্তর ফারাক। কাজেই ১৯৪৬–৪৭–এর একচোখো ইতিহাসে গোপাল পাঁঠা যদি (কোনও ভয়ঙ্কর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে) পশ্চিমবঙ্গের রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠেন তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর তাছাড়া হিন্দু সংহতির ফেসবুক পাতায় গেলেই দেখা যাবে যে তারা হিন্দু বাঙালির বাঁচার একটিই পথ বাৎলেছে: তা হল তাকে ‘সুশীল সমাজ’ থেকে নাগরিক সমাজে পরিবর্তিত হতে হবে। তবে কিনা জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর কোপ থেকে আদৌ কত জন বাঙালি গর্দান বাঁচাতে পারেন তা দেখে নিয়ে তারপরেই যদি তাঁরা তাঁদের সামরিক বাহিনীটি গঠন করেন তবে সবদিক থেকেই রক্ষে হয়!
প্রসিত দাস একজন স্বতন্ত্র সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী। সমস্ত ছবির সূত্র ইন্টারনেট।
Like once George Orwell said- The most effective way to destroy people is to deny and obliterate their own understanding of their history.