গণি খান চৌধুরী ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (জি.কে.সি.আই.ই.টি) মালদায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ একটি কলেজ। সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা ডিগ্রী-রেজাল্ট-পড়াশুনার সুযোগের বদলে পেয়েছেন মড্য়ুলার মডেলে শিক্ষার নামে প্রতারণা ও এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ। হার না মানা ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, এবারে তাঁরা নামলেন কলকাতার পথে, সহযোগিতার সন্ধানে। লিখেছেন ইমন সাঁতরা।
অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের গেটের সামনে বকুল গাছের তলার কংক্রিট চাতাল। চা-রোল-সিগারেটের দোকানগুলোর পায়ের কাছে পলিথিন চট পাতা। ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে কলেজের ব্যাকপ্যাক। প্যান্ট জামা স্যান্ডোগেঞ্জি। রঙিন আর্টপেপারে মার্কারপেন দিয়ে লেখা পোস্টার। বিধ্বস্ত কয়েকটা তরুণ শরীর। খাঁখাঁ রোদে বৃদ্ধ বকুলের গোড়ায় বাঁধানো চাতালে গায়ে গায়ে বসে। কেউ কেউ রোদেই মুখে রুমাল ফেলে চোখ বুজেছে। মুখভরা উদ্বেগ, ক্লান্তি। কোটরগত চোখগুলোয় পোস্টারে লেখা উচ্চারণের প্রতিচ্ছবি — হয় বৈধ সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে বাড়ি যাব নতুবা বাড়ি ফিরবই না।
পাশেই রাণু-ছায়া মঞ্চ। রোববারের দুপুরে অল্প অল্প জমতে শুরু করেছে যুগল, সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালি, তরুণ-তরুণী-প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া। কাছেই পাবলিক টয়লেটের সামনের ফাঁকায় ৯ মিটার সাদা থানে রঙে-তুলিতে ব্যানার লিখছে ঝকঝকে কিছু তরুণ তরুণী।এই রাণু-ছায়ার সামনে ছাত্রছাত্রী, রাজনৈতিক গ্রুপ, এন জি ও-দের অনেক প্রতিবাদ সমাবেশ দেখেছি। অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিটের সলিডারিটিতে বর্ণিল উদযাপন দেখেছি এখানে। কিন্তু এভাবে চাতাল জুড়ে সত্যি সত্যি অক্যুপাই তো দেখিনি! লোকজনকে জিগেস করে জানলাম এটাই প্রথম। বয়স্করাও মনে করতে পারছেন না এমন দৃশ্য।
ব্যাপার কী?
মালদা বললেই আদিনা মসজিদ যত না মনে আসে, গণিখান চৌধুরী আসেন তারও আগে। ২০১০ সালে কেন্দ্র সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ন্যাশনাল ইন্সটিট্যুট অব টেকনোলজির অধীনে মালদায় তাঁর নামেই গনিখান চৌধুরী ইন্সটিট্যুট অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। সংক্ষেপে GKCIET। মালদার নারায়ণপুরে মূলভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। এই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট বলছে ‘The Institute’s main objectives are (i) to offer flexible, modular, credit based multi-point entry programmes in engineering and technology’।
এই মড্যুলার কথাটি ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন। তারই পরীক্ষাগার ছিল জিকেসিআইইটি। গিনিপিগ নতুন কলেজে পড়তে আসা নাদান ছাত্রছাত্রীরা। তাদের অভিভাবকরাও। মড্যুলার মডেল ফেল। পরীক্ষক হাত গুটিয়ে নিয়েছে। পরীক্ষাগার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। গিনিপিগরা রাণু-ছায়ায় গড়াচ্ছে। বলা হয়েছিল, মড্যুলার মডেলে মাধ্যমিক বা সমতুল পাসের পর যারা সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে এখানে ঢোকার সুযোগ পাবে, তাদের শিক্ষাক্রম হবে—
- প্রথম দু’বছর—ভোকেশনাল কোর্সে সার্টিফিকেট, যা উচ্চমাধ্যমিকের সমতুল।
- পরের দু’বছর— ডিপ্লোমা অর্থাৎ পলিটেকনিকের সমতুল।
- শেষ দুবছর— বি টেক ডিগ্রি।
অর্থাৎ অনেকটা ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেমের ধাঁচে মাধ্যমিকের পর থেকেই পড়াশুনা করে বি টেক ডিগ্রি পাওয়ার ব্যবস্থা। কেউ চাইলে প্রথম বা দ্বিতীয় ধাপে পড়া ছেড়েও দিতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা দেওয়া হবে। আবার পরবর্তী দুটি ধাপেই নতুন পড়ুয়া ভর্তি হতে পারে। ইন্টিগ্রেটেড ব্যবস্থার সাথে মূল তফাৎ এটুকুই। এজন্যই এর নামকরণ হল মড্যুলার।
২০১০ সালেই মাধ্যমিক পাসদের নিয়ে সার্টিফিকেট স্তরের পঠনপাঠন শুরু করতে GET পরীক্ষার বিজ্ঞাপনও প্রদর্শিত হল দেশ জুড়ে। কেন্দ্র সরকারি কলেজ যে! শুরু হয়ে গেল সার্টিফিকেট স্তরের পঠনপাঠন। ২০১২ সালে সার্টিফিকেট প্রাপক ও GET পরীক্ষারমাধ্যমে আসা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শুরু হল ডিপ্লোমা কোর্স। বিল্ডিং বানানোও চলছে পুরোদমে। মেঘ যে জমতে পারে তার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি নবনির্মিত ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করলেন। আর সেই বছরই ডিপ্লোমাহোল্ডার ও নতুন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শুরু হল প্রথম বি টেক কোর্স। সেটা ২০১৪।
দু’বছর পর ২০১৬, প্রথম বি টেক ব্যাচ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল। তখনই জানা গেল কলেজের নাকি স্বীকৃতিই নেই। ছ’বছর পড়ার পর জানা গেল একটা সরকারি কলেজ নাকি ভুয়া! পড়ুয়া আর অভিভাবকদের অবস্থা কল্পনা করা কঠিন কি?
ঘটনাপ্রবাহ (মালদহ)
কলকাতা থেকে বহুদূরের এই কলেজে, প্রচুর পড়ুয়া এসেছে বিহার উত্তরপ্রদেশের প্রান্তিক গ্রাম থেকে। অরুণাচল, মনিপুর, মেঘালয় থেকেও এসেছে ছাত্রছাত্রীরা। মালদা থেকে যারা, তাদেরও বাস প্রান্তিক গ্রামে। জিকেসিআইইটি-র বেশিরভাগ পড়ুয়া সংখ্যালঘু, দলিত, তফসিলভুক্ত। দরিদ্র। অনেকসময় প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। ছ’বছরে বি টেকের আশায় জমি বিক্রি করে অথবা মায়ের গয়না বন্দক দিয়ে এসেছে অনেকে। অন্য রাজ্যের দরিদ্র পড়ুয়ারা শূন্যহাতে সর্বস্বান্ত হয়ে আরও কিছু খোয়ানোর ভয়ে ‘দেশ’-এ ফিরে গেছে, অনেকেই। তাও, যারা রয়ে গেল চোয়াল চেপে, মালদারই বেশি, শুরু করল দৌড়ঝাঁপ। কর্তৃপক্ষের কাছে দরবার।প্রথম ব্যাচের পাস-আউটদের সুরাহা তো হলই না, উলটে ২০১৬-র সেকেন্ড ব্যাচের পরীক্ষাও স্থগিদ করে দিল অথরিটি। উদ্দেশ্য, দুটো ব্যাচকে পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা। যদিও কর্তৃপক্ষের হীন চক্রান্ত ছাত্র ঐক্যের সামনে কবেই বা টিকেছে! জুলাই মাসে জাতীয় সড়ক অবরোধ করল ছাত্রছাত্রীরা। কলেজে ক্লাস নেই, পরীক্ষা বন্ধ তো কী, রাস্তা আটকে পড়াশুনো শুরু করেছিল ওরা।গোটা বছর চলে গেল। কারো কিছু এল গেল না।৮০০ জন প্রতারিত ছাত্রছাত্রীর সেই চলমান আন্দোলন থেকেই ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে জন্ম নিল সম্পূর্ণ অদলীয় ছাত্র ইউনিয়ন GKCIET Students’ Unity। ইউনিয়নকে মান্যতা দিতে বাধ্য হল কর্তৃপক্ষ। চাপের মুখে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এই সময়ই জানালো NIT দুর্গাপুর অ্যাফিলিয়েশন দেবে। কিন্তু দীর্ঘ টালবাহানার পর দুর্গাপুর জানিয়ে দিল, স্বীকৃতি দিতে তারা অপারগ।
টানা ২০১৭ জুড়ে এই ‘বানে ভাসা’ পড়ুয়ারা সমস্ত দপ্তরের সাথে সাথেই সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে গেছে। প্রতীকী রেল ও সড়ক অবরোধ, নারায়ণপুরে রাজ্যশিক্ষাদপ্তরের সামনে ধর্না, ২৬ দিনের অনশন থেকে নানারকম কর্মসূচী নিতে নিতে ক্লান্ত হলেও হাল ছাড়েনি।
সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা ছিল প্রফেসর-ইন-চার্জ শুভাশিস দত্ত এবং এন আই টি দুর্গাপুরের ডিরেক্টর দে’র। ২০১৭-র ডিসেম্বরে চার জন আন্দোলনরত ছাত্রের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করে শুভাশিস দত্ত।
উর্দ্ধ থেকে উর্দ্ধতর কর্তৃপক্ষের শয়তানির এত ভালো উদাহরণ বোধহয় কম। এম এইচ আর ডি স্টেট এডুকেশন কাউন্সিল একে অপরের পিঠ চাপড়ে এই ৮০০ জনকে দমবন্ধ করে মারতে চেয়েছে। এমনকি ২০১৭ থেকে ভর্তির বিজ্ঞপ্তিতে মড্যুলারের কোনো চিহ্ন রাখা হয়নি। আর পাঁচটা কলেজের মতো তিন বছরের ডিপ্লোমা বা চার বছরের বিটেকের জন্য ভর্তি নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সবদিক দিয়ে এতগুলো পড়ুয়াকে শিক্ষা ও কর্মের অঙ্গন থেকে জাস্ট নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চক্রান্ত! এরকম আগে কোথাও হয়েছে কিনা মনে করতে পারছে না বিশেষজ্ঞ মহল।
কলেজটা সর্বাংশে জালি। গত দুবছর নতুন ছাত্রছাত্রীদের কাউন্সেলিং হচ্ছে দার্জিলিং বা শিলিগুড়ির ঝকঝকে হোটেলে। যাতে নতুন পড়ুয়া আর অভিভাবকরা ঘুণাক্ষরেও টের না পায় কিছু। কতশত পড়ুয়ার আশু সর্বনাশ! লড়াইয়ে থাকা মুখগুলি ওদেরকেও বাঁচাতে বদ্ধপরিকর।
৮ আগস্ট, ২০১৭ জিকেসিআইইটি’র নতুন ডিরেক্টর আসেন। ছেলেমেয়েরা আশায় বুক বাঁধে। তাকে সমস্ত নতুন করে জানালে তিনি ছয় মাস সময় দেন। তাঁর কাছে ছাত্রছাত্রীদের দাবী ছিল —
- এম এইচ আর ডি থেকে বিটেক’দের সার্টিফিকেট।
- ২+২ ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট।
- যাদের অপেক্ষা করে সময় গেল তাদের এই কলেজেই পরের কোর্সে ভর্তির নিশ্চয়তা।
ছ’মাস কেটে যায়। শুভাশিস দত্তর প্রফেরশিপ জালি প্রমাণিত হওয়া ছাড়া ছাত্রছাত্রীদের খুশি হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি।
২০১৮-র ফেব্রুয়ারি থেকেই পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়েছে। ৮০০ পড়ুয়ার সুরাহা হল না। ডিরেক্টর বিপুল বাজেটের কলেজ স্পোর্টস আয়োজনে মেতে গেলেন। পড়ুয়ারা স্পোর্টস বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলে, ডিরেক্টর নানারকম কম সময়ের ক্র্যাসকোর্সের জন্য স্যাংক্সন বের করে তাতে নতুন ভর্তি নিয়ে, তাদেরকে অংশগ্রহণ করিয়ে খেলার অনুষ্ঠান চালিয়েছেন বলে অভিযোগ। মার্চ মাসে GKCIET-র সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে লড়াই করতে থাকা ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন ক্যান্সেল করে দেওয়া হয়েছে। মার্চ-এপ্রিলে একাধিকবার গার্লস হস্টেলের যেদিকে প্রতারিত ছাত্রীদের বাস সেদিকে ইলেক্ট্রিসিটি কেটে দিয়েছে বিদ্যুৎ দপ্তর। কারণ কর্তৃপক্ষ বহুদিন বিল মেটায়নি। মমবাতি জ্বেলে আঁধার রাতে ব্রাত্য হয়ে বসে থেকেছে মেয়েরা। ডিরেক্টরকে এসব অভিযোগ করে কোনো লাভ হয়নি, যথারীতি। এনআইটি-র ডিরেক্টরকে জানানো হলে বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও তিনি হিন্দিতে বলেছেন “তোমরা আমার সম্বন্ধে খারাপ কথা লিখে দেওয়াল ভরিয়ে দাও। তোমাদের কোনো ব্যবস্থা করব না”। আত্মহত্যা ছাড়া পথ নেই — একথার উত্তরে তিনি সরাসরি ছাত্রীটিকে আত্মহত্যা করে নিতে বলেছেন।
মে থেকে ফের বিক্ষোভ শুরু করে পড়ুয়ারা। ডিরেক্টর তখন দিল্লি চলে গেছেন।
জুন, ২০১৮। লাগাতার আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (MAKAUT) বি টেক ডিগ্রির স্বীকৃতি দিল। ডিপ্লোমার স্বীকৃতি দিল স্টেট কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন। তার মানে দাঁড়ালো ২০১৮ থেকেই JEXPO-র মাধ্যমে ডিপ্লোমাস্তরে ও WBJEE-র মাধ্যমে ডিগ্রি স্তরে ভর্তি হতে হবে। অতএব জিকেসিআইইটি বৈধ ডিপ্লোমা ও ডিগ্রি দিতে পারবে। তাহলে সমস্যা মিটে গেল!
নাহ, এইবার আসল সমস্যা। জানা গেল—
- ২০১০ থেকে আজ পর্যন্ত যাঁরা সার্টিফিকেট কোর্স করেছেন, তাদের কোনও মান্যতা নেই
- ২০১৪ থেকে ২০১৭-য় ডিপ্লোমা পাসদের মান্যতা নেই
- ২০১৬ ও ১৭-য় যারা ডিগ্রি পাশ করেছেন তাদেরও মান্যতা নেই।
- এমনকি যারা এই অস্বীকৃত ডিগ্রি পেয়েছেন, তাদের ডিপ্লোমাহোল্ডার হিসাবে বি টেকে কোল্যাতারাল এন্ট্রির রাস্তাও বন্ধ। কারণ তাদের সার্টিফিকেটের কোনও মান্যতা নেই।
অর্থাৎ, মড্যুলার ব্যবস্থায় বি টেক পর্যন্ত ৬ বছর পড়ল যারা, তারা বৈধ যোগ্যতার বিচারে পারতপক্ষে মাধ্যমিক পাস ছাড়া কিছুই না।
২ জুন এডিএম-কে সমস্ত লিখিত দেওয়ার পর উনি সব দেখে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সেই যে অদৃশ্য হয়েছেন আর কোনো খোঁজ নেই। অফিসে আছেন তবু নেই। ২৩ জুন থেকে শুরু হয় আমরণ অনশন। প্রবল গরমে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ১৬ দিনের মাথায় ৮ জুলাই অনশন তুলে নেয়। ১৮ জুলাই ডিএম-এর সাথে দেখা করে ছেলেমেয়েরা। উত্তর না মেলায় ২৩ তারিখ ডিএম-কে চিঠি দিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা। শুরু হয় অবস্থান। পরীক্ষা বয়কট। মেয়েরা কলেজের প্রধান প্রশাসনিক গেটের সামনে শুয়ে পড়ে। নুজরত বানু এবং সুপ্রিয়া সরকার অনসনে বসেন। একসপ্তাহ অনশনের পর নুজরত বানু অসুস্থ হয়ে পড়লে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা দূর কুশল সংবাদ নেয়নি পর্যন্ত।
কলকাতার রাজপথে
৬ আগস্ট মালদা থেকেই স্পিড পোস্ট ও মেইলে রাজ্যপালের সাথে দেখা করতে চেয়ে আবেদন জানায় জিকেসিআইইটি-র প্রতারিত পড়ুয়ারা। ৭ তারিখ মঙ্গলবার তাদের চল্লিশ জন প্রতিনিধি কলকাতায় আসে। যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাদের পাশে দাঁড়ায়। মেডিক্যাল কলেজ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বারুইপুর পলিটেকনিকের ছাত্রছাত্রীরাও ঘোষণা করে পাশে থাকার। ৮ আগস্ট কলেজ স্কোয়ারে এবং ৯ তারিখে যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ডে প্রচারাভিযান চালায়। রাজ্যপালের উত্তর না আসায় শুক্রবার (১০ আগস্ট) থেকে ওরা রাণু-ছায়ার নিচে বসে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখানে পুলিশ বারবার হুমকি দিয়ে তুলে দেবার চেষ্টা করে। এমনকি মাথায় ছাউনিও লাগাতে দেয়নি পুলিশ। আন্দোলনকারীদের তরফে থানায় অবস্থানের চিঠি দিতে গেলে তা নিতে অস্বীকার করে পুলিশ।
আন্দোলনকারী ছাত্ররা প্রচারপত্রে স্পষ্ট জানায় এখন থেকে তাদের দায়িত্ব কলকাতার সমাজের। তারা বৈধ সার্টিফিকেট ছাড়া কলকাতা ছাড়বে না। তারা আহ্বান জানায় বাংলার সমস্ত মানুষকে, যাতে তারা আরো মানুষকে বলতে পারে এই ভয়াল প্রতারণার কথা। সাথে তুলে দিতে পারে পথের প্রান্তে এক কাপড়ে পড়ে থাকা ছেলেগুলোর জন্য আর্থিক কিছু সাহায্য আর কর্তৃপক্ষের জগদ্দল নাড়ানোর জন্য সাধারণ মানুষের লক্ষ লক্ষ সই। কলকাতার নানান জায়গায় প্রচারের সময় শুধু আর্থিক সাহায্য নয়, তারা চাল-ডালও সংগ্রহ করে। তারা জেনেছে, সরকারের একটা সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষমতা থাকতে না পারে, শহরবাসীর তাদের বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা খুবই আছে। একজন ছাত্র, নুজমুল হক, অবশ্য চেয়ে খাওয়ার চাইতে না খেয়ে থাকাকেই রাস্তা মেনেছে। সে অনশনে।
তবে অ্যাকাডেমি চত্বরের অদৃষ্টপূর্ব অক্যুপাই আক্ষরিক অর্থেই কলকাতার ধোপদুরস্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মখমলী ভাতের থালায় কাঁকড় হয়ে উঠেছে। মেইন মিডিয়া ইচ্ছে করে ভয়াল খবরটিকে চেপে যাচ্ছে। মালদার ভিন্নভাষাসংস্কৃতির ছেলেগুলোকে দীর্ঘ অনিশ্চয়তা আর হাড়ভাঙা লড়াইয়ে প্রাথমিক ভাবে বিধ্বস্ত লাগলেও, কিছুক্ষণ তাদের সাথে কাটালেই অনুভব করা যায় তাদেরই ভয়ডরহীন অ-কলকাত্তাইয়া কলতানে মেতে আছে টিপটপ সংস্কৃতির সাজানো বাগান। গত শুক্রবার (১০ আগস্ট, ২০১৮) থেকেই দিনে-রাতে তাদের হাতেহাত ধরে আছে কলকাতার কলেজ ইউনিভার্সিটির কলরবীরা। পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন শিল্পসাহিত্য জগত ও গণ-আন্দোলনের কর্মীরা। পোষাকে-আশাকে, উচ্চারণে-উদ্দীপনায় এ যেন সমকালীন ভারতে ছড়াতে থাকা বিভেদবিষের মুখে একপ্রস্থ সহজ অ্যান্টিজেন। হতাশার গভীর আঁধারে বিচিত্র প্রাণোচ্ছল মুখরতা। পোস্টারে-স্লোগানে-গানে-কথনে মালদা জেলার ছাত্র আন্দোলন যেমন পোক্ত হচ্ছে, কলকাতার সুদীর্ঘ ছাত্র আন্দোলনের ধারায় জিকেসিআইটির ছাত্রেরা জুড়ে দিচ্ছে হোক-কলরবোত্তর তাজা পালক।
যদিও প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা চলছে বক্তব্য-গান-বাজনা, সমাজের সকলস্তরের মানুষকে বিশেষ ভাবে ডেকেছিল এই আন্দোলন, রোববার ১২ আগস্টের সাংস্কৃতিক কনভেনশনে। সেখানেও কনভেনশনের সঞ্চালক মালদাবাসী সুজন বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল, তাদের কলকাতা আসার উদ্দেশ্য। আহ্বান করছিল, সকল সমানুভব মানুষ যেন তার তার দল ও রাজনৈতিক স্বার্থ আপাতত পিছনে ফেলে এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান।সঞ্চালক সুজন বারবার জানায় একমুহূর্তের জন্যে তারা ভুলে যাচ্ছে না সেই একগুচ্ছ পড়ুয়ার কথা যারা নারায়ণপুরে জিকেসিআইটির বুঁদির গড় আগলাচ্ছে। কলকাতায় তো রাজপথ। রোদে পুড়লেও নতুন বন্ধুদের এগিয়ে দেওয়া ছায়া, বৃষ্টি হলে বসার চটকে হাতেহাত মাথার ছাউনি বানানো। ওখানে কর্তৃপক্ষ আর প্রশাসনের সরাসরি শত্রুতার মুখে ছাত্রীদের অবস্থান। সাপ বিছে উঠে আসছে গায়ে। মাথায় হুমকির মেঘ। মালদা মেডিক্যালে অসুস্থ নুজরতের লড়াই। সুপ্রিয়াদের জেদ।
১৩ ও ১৪ আগস্ট আবার চলেছে কলকাতার নানা জায়গায় প্রচার। রাজ্যপালের সাড়া যথারীতি পাওয়া যায়নি। উচ্চশিক্ষামন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। স্টেট কাউন্সিলের প্রধান সন্দীপ কুণ্ডুর সাথে দেখা করে ছাত্ররা জানিয়েছে, তাদের দেওয়া ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট কোথাও কেউ নিচ্ছে না। মার্চেন্ট নেভি, এয়ার ফোর্সের মতো সরকারি দপ্তর চাকরি পরীক্ষায় পাশ করা ছাত্রকে ফিরিয়ে দিয়েছে কারণ তার নথি ভুয়া। সন্দীপ বাবু অসাধারণ নিদান দিয়েছেন: যে নিচ্ছে না, তার বিরুদ্ধে কেস করো। নবান্নতেও চিঠি পৌঁছানো হয়েছে।
বেঁধে থাকার বিস্তার
আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কী হবে, পরবর্তী কর্মসূচীই বা কী, নির্ধারিত হচ্ছে সাধারণ সভায়। এক্ষেত্রে দূরাগত ছাত্রেরা তাদের নেতৃত্ববিহীন আন্দোলনের রাশ কিন্তু জিবির হাতেই রেখেছে। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসছে, স্টেট কাউন্সিল না রাজ্যপাল, অবস্থান না অনশন। ভয় থাকছে। স্বাধীনতা দিবস পালনের ঢক্কানিনাদে প্রস্তুত করা হচ্ছে কল্লোলিনী কলকাতাকে। ছাত্রদের অবস্থানস্থল নাকি আর্মির আন্ডারে। পবিত্র স্বাধীনতা দিবসের আগে এইসব উটকো ঝামেলা কী রাখবে পুলিশ! আশঙ্কায় একটা দিন কাটছে যেন এক বছর!
দশদিন কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে জিকেসিআইটির ন্যায্য আন্দোলন সাধারণ মানুষের যা সমর্থন সহযোগিতা পেয়েছে, এবং প্রশাসনের কর্তারা যেভাবে পাল্লা দিয়ে নীরব থেকেছে, তাতেই আন্দোলনকারীরা নিজেদের পরিস্থিতি স্পষ্ট বুঝেছে। এই বঞ্চনার কথা, তার বিপরীতে মরণপণ লড়াইয়ের কথা আরও বেশি করে সারা রাজ্যে এমনকি দেশের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ুক, চাইছে তারা।
১৪ আগস্ট বিকালে হাওড়ার পাঁচলা, উত্তর চব্বিশ পরগণার বারাসত ও হুগলির শ্রীরামপুরে জিকেসিআইইটির প্রতারিতদের সংহতি ও সহযোগিতার জন্য পথসভা হয়েছে। ১৫ আগস্ট হুগলির নালিকুলে পথসভা। ১৬ তারিখ বর্ধমান রেল স্টেশন থেকে গোটা শহরে নগর-ভ্রমণ করে প্রচার ও অর্থসাহায্য করবে বর্ধমানের পড়ুয়ারা। খড়দা, নুঙ্গি ইত্যাদি জায়গাতেও সংহতি অনুষ্ঠান হতে চলেছে।
শিক্ষা আমাদের দেশে পণ্য হয়েছে কবেই। সে পণ্য মুনাফাখোরের হাতে তুলে দেওয়া হয় নয়ের দশক থেকে। সুদখোর, প্রোমোটার, রাজনৈতিক নেতাদের সাইড বিজনেস এখন ইঞ্জিনিয়ারিং আর বি এড কলেজ বানানো। গত দশবছরে এইসব কলেজে পড়তে গিয়ে ভিটেমাটিচাটি করে কত ছেলেমেয়ে যে ভুয়ো বনে গেছে শিক্ষা আর চাকরির মানচিত্রে, কত মায়ের কোল ফাঁকা হয়ে গেছে অকাল আত্মহত্যায় ইয়ত্তা নেই। আর বেওসাদারের পেট ফুলেছে। যেখানে সেখানে জলাজমি, ফলেরবাগান ধ্বংস করে মাথা তুলেছে একের পর এক ঝাঁচকচকে ভুয়ো কলেজ।
জিকেসিআইইটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো সরকারি-বেসরকারি বলে কিছু তফাৎ নেই, এই মুনাফাকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় নাগরিকের অধিকার দূর, পরিচিতিও সুরক্ষিত নয়। সরকারের কাজও অসাধু ব্যবসায়ীর মতো, প্রতারণা। রুখে দাঁড়ানোর পাঠ দিচ্ছে জিকেসিআইটির অদম্য অনমনীয় ছাত্রছাত্রীরা, কলকাতার খোলা রাস্তায়। পারলে নিজের কাজের সময় বাঁচিয়ে নিখরচায় ক্লাস করে আসুন। এই কোর্সের সার্টিফিকেট দেখা যায় না। বুকে বইতে হয়। ভুয়ো হবার ভয় নেই।
ছবি – আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সোশ্যাল মিডিয়া পেজ থেকে