ফলতা সেজ(এস.ই.জেড.)-এর চেভিয়েট(Cheviot) কোম্পানীর শ্রমিকবিরোধী নীতি ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত ভাবে লড়ছেন চেভিয়েটের শ্রমিকরা। ম্যানেজমেন্ট ও সরকারের মিলিত প্রচেষ্টা দমিয়ে রাখতে পারছে না তাঁদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন। লিখছেন সঞ্জয় পাঠক।
গত ৬ জুন ফলতা ‘সেজ’-এর চেভিয়েট কোম্পানীতে ‘চেভিয়েট কোম্পানী কন্ট্রাক্টরস সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন’-এর সভাপতি অশোক কবিকে অন্যায় ভাবে বরখাস্ত করার প্রতিবাদে এবং তাঁকে কাজে পুনর্বহালের দাবিতে ঐ কারখানার সমস্ত শ্রমিক ঐ দিন প্রতি শিফটে ১ ঘন্টা করে ‘টুল ডাউন’ ধর্মঘট করেন। এতেও ম্যানেজমেন্ট অনড় থাকায় গত ২০শে জুলাই সমস্ত শিফটে সর্বাত্মক ধর্মঘটে সামিল হন শ্রমিকরা। ‘সেজ’-এর শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই ঘটনা এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। এখানে উল্লেখ্য, একই দাবিতে উভয় দিনে স্থায়ী শ্রমিকদের সংগঠন ‘চেভিয়েট কোম্পানী পার্মানেন্ট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন’ও ‘টুল ডাউন’ এবং ধর্মঘটের প্রোগ্রামে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
দীর্ঘদিন ধরে অশোক কবিকে কাজে না ফেরানোর বিষয়ে ম্যানেজমেন্টের অনমনীয় মনোভাব স্থায়ী ও কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের শুধু ক্ষুব্ধ করে নি, শ্রমিকরা এর একটা চটজলদি বিহিত চাইছিলেন। চাইছিলেন একটা মোক্ষম জবাব দিতে। দুটি ইউনিয়নের নেতৃত্ব ও শ্রমিকরা একসাথে বসে ঠিক করেছিলেন, ‘ম্যানেজমেন্টের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে প্রথমে ‘টুল ডাউন’ করা হবে, তাতেও টনক না নড়লে এক দিন বা লাগাতার ধর্মঘটের দিকে যেতে হবে। ম্যানেজমেন্টকে বুঝিয়ে দিতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা যৌথ ভাবে লড়তে জানে’। যৌথ ইউনিয়নের মিটিং-এ ঠিক হয়েছিল, প্রত্যেক শিফটে ১ ঘন্টা করে ‘টুল ডাউন’ করা হবে। কিরকম? মর্নিং ও জেনারেল শিফটের সময় স্থির হয়েছিল সকাল ১১টা থেকে ১২টা, বি শিফটের সময় নির্ধারিত হয়েছিল বিকেল ৫টা থেকে ৬টা এবং নাইট শিফটের সময় ছিল রাত ১১টা থেকে ১২টা। প্রত্যেক শিফটের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের মুখিয়া শ্রমিকদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছিলেন ইউনিয়নের নেতৃত্ব। সেই সভাতে শ্রমিকরা আর একটি এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যা শ্রমিক সংহতির অনন্য নজির, অন্তত আজকের শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তো বটেই। তা ছিল, যত দিন না ম্যানেজমেন্ট অশোক কবিকে কাজে ফিরিয়ে নেবে, ততদিন শ্রমিকরা চাঁদা তুলে তাঁর পুরো বেতন প্রতি মাসে পরিবারের হাতে তুলে দেবে। যা আজও চলছে। এখন দেখে নেওয়া যাক ‘টুল ডাউন’ প্রোগ্রামটি কেমন ছিল?
‘টুল ডাউন’ প্রোগ্রাম
সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টো ‘এ’ শিফট, ‘জেনারেল’ শিফট সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা। আর নাইট শিফট রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা। অন্যান্য দিনের মতো ঐ দিন শ্রমিকরা কারখানায় উপস্থিত হলেও, সেদিন তাঁদের ‘মুড’ ছিল অন্য রকম। চেভিয়েট কোম্পানীর জীবনে এই প্রথম সেদিন ঠিক সকাল ১১ টায় ঘটল অন্য রকম এক ঘটনা। এক যোগে স্থব্ধ হয়ে গেল সমস্ত মেশিনের রোজকার কলরব। মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন চেভিয়েটের লড়াকু অকুতোভয় শ্রমিকরা। সেই অখন্ড ১ ঘন্টা মেশিনের নীরবতা ম্যানেজমেন্টকে ভিতর থেকে অস্থির করে তুললেও তার বহিঃপ্রকাশ ছিল না। ম্যানেজমেন্টের কর্তাব্যক্তিরা এলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, কেন মেশিন বন্ধ? অনেকেই জবাব দিয়েছিলেন, তবে তাঁদের মূল সুরটি ছিল এরকম – ‘আমরা ‘টুল ডাউন’ করেছি অশোককে কাজে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিতে। ওকে কাজে ফিরিয়ে নিন, না হলে আগামী দিনে আরও বড় লড়াই হবে।’ ঠিক ১২টার সময় আবার মেশিন চালু হয়েছিল। অন্যান্য শিফটেও প্রায় একই ধরণের প্রোগ্রাম চলে। আর একটি ঘটনা সেদিন ঘটেছিল। ম্যানেজমেন্ট প্রত্যেক শ্রমিকের গড়ে দৈনিক ২০ টাকা করে বেতন বৃদ্ধির নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়। কেন সেদিনই নোটিশ দিল? এর দুটি দিক আছে বলে মনে করা যেতে পারে। প্রথমত ম্যানেজমেন্ট হিসেব কষেছিল, বেতন বৃদ্ধির নোটিশের ফলে শ্রমিকরা খুশী হয়ে ‘টুল ডাউন’ থেকে বিরত থাকবে। দ্বিতীয়ত তারা আন্দোলনের সূচনায় ভয় পায়, অর্থাৎ, শ্রমিকদের পেশ করা যে দাবিসনদ নিয়ে যে ম্যানেজমেন্ট এত দিন কোন পাত্তাই দেয় নি, শ্রমিক আন্দোলনের চাপে পড়ে সেই ম্যানেজমেন্টই বেতন বৃদ্ধির নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছিল। যদিও এই এক তরফা নোটিশের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা তাঁদের ক্ষোভ উগরে দেন ঐ দিনই। এই আন্দোলনের ফলে শ্রমিক আন্দোলনের দিক থেকে একটি গভীর বিষয় সামনের সারিতে উঠে এল। বেশ কিছু সময় ধরে গোটা দেশে মালিকী আক্রমণ তীব্র হওয়ার প্রেক্ষিতে শ্রমিক জাগরণ সেভাবে হচ্ছে না। ছাঁটাই, লকআউট এখন রোজকার ঘটনা। লড়াই, আন্দোলনের দিকে শ্রমিকরা সেইভাবে যেতে চাইছেন না। সেখানে কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের পাশে থেকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পার্মানেন্ট শ্রমিকরা লড়াই-তে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, এটা যেমন তেমন ব্যাপার নয়। এই কাজ করতে যে মনোবল লাগে, শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি যে সহমর্মিতা লাগে, তা এখানে অটুট ছিল। অন্য কথায়, শ্রমিক সংহতির এক অনন্য নজির তৈরী করেছেন ‘চেভিয়েট’-এর লড়াকু শ্রমিকরা। এখন প্রশ্ন, কেন ‘চেভিয়েট কোম্পানী কন্ট্রাক্টরস সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন’-এর সভাপতিকে ম্যানেজমেন্ট ছাঁটাই করল? সে বিষয়টি বোঝার আগে চটজলদি দেখে নেওয়া যাক কোম্পানীর উৎপাদনের দিকটি।
১৯৬৮ সালে চেভিয়েট কোম্পানী ‘বজবজ অ্যালগামেটেড মিলস লিমিটেড’ তৈরী করে যেখানে চটের সূতো ও কাপড় উৎপাদন করে ভারতে ও বিদেশে বিক্রি করা শুরু করে। এদের উৎপাদনের মধ্যে আছে স্যাকিং ব্যাগ, কাপড়, হেসিয়ান কাপড় এবং রকমারি ফেব্রিকস। ২০০৩-এর মার্চে ফলতা স্পেশাল ইকনমিক জোন-এ চেভিয়েট কোম্পানী একটি ১০০ শতাংশ এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ইউনিট খোলে। কেন চেভিয়েট বা তার মত বিভিন্ন কোম্পানী ফলতা ‘সেজ’-এ তাদের ইউনিট খুলতে গেল? ফলতা ‘সেজ’ কি এবং কেন তৈরী হল? এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে নেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
ফলতা ‘সেজ’ কি এবং কেন
৯০-এর দশকে বিশ্বায়নের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে আমাদের দেশে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য ‘সেজ’। আমাদের দেশে ‘সেজ’ অর্থাৎ ‘স্পেশাল ইকনমিক জোন’-এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বিজেপি জোট সরকারের আমলে। ভারত সরকার তার শিল্পমন্ত্রকের ওয়েবসাইটে ঘোষণা করেছেন: “‘সেজ’ অঞ্চল একটি বিশেষভাবে চিহ্নিত করা শুল্কমুক্ত এলাকা এবং বাণিজ্য, শুল্ক এবং মাসুলের প্রেক্ষিতে অঞ্চলটিকে বিদেশী ভূখন্ড হিসেবেই গণ্য করতে হবে।” দেশী-বিদেশী মালিকগোষ্ঠীর লুণ্ঠন ও শোষণকে অবাধ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির মদতে গোটা ভারতে তৈরী হয়েছে অসংখ্য ‘সেজ’। ফলতার ‘সেজ’ তারই একটি। বাম সরকারের আমলে কিভাবে ফলতায় ‘সেজ’ গড়ে উঠল?
বাম আমলে ফলতায় ‘সেজ’
‘বামফ্রন্ট’ সরকারের আমলে ‘ফলতা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন’ গঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। পরবর্তী ক্ষেত্রে এর নাম হয় ‘ফলতা ফ্রি ট্রেড জোন’। ফলতা ‘সেজ’-এর শ্রমিকরা চলতি ভাষায় একে ‘ফিটার জোন’ বলে থাকেন। ২০০৩ সালে পূর্বতন ‘বাম সরকার’ এই এলাকাকে ‘স্পেশাল ইকনমিক জোন’ (বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল) বলে ঘোষণা করেন। ফলতা ‘সেজ’ হোল পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে একমাত্র বহুমুখী উৎপাদন কেন্দ্র। কলকাতা থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ ২৪ পরগণায় গঙ্গা নদীর গায়ে সস্তায় পণ্য উৎপাদন এবং বিদেশে পণ্য রপ্তানির সুবিধার্থে এই ‘সেজ’ গড়ে তোলা হয়েছে। প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল রায়চক পর্যন্ত ‘সেজ’ সম্প্রসারিত করা হবে। কিন্তু স্থানীয় মানুষদের বাধায় তা হয়ে ওঠেনি। ‘সেজ’-এর মোট অধিগৃহীত জমির পরিমান ২৮০ একর। এরমধ্যে কোলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের জমি ১৯৩ একর, বাকী ৮৭ একর জমি আঞ্চলিক কৃষকদের কাছ থেকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। ফলতা ‘সেজ’-এর মোট আয়তন ১.১২ বর্গ কি.মি।
‘সেজ’-এ মালিকদের সরকার কিভাবে তোয়াজ করল?
‘সেজ’ এর ডেভেলপমেন্ট কমিশনারকে যেকোনো কারখানা করার অনুমতি, ছাড়পত্র, লাইসেন্স ইত্যাদি দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পূর্বতন বাম সরকার ঘোষণা করেছিল, ‘সেজ’ এর কারখানাগুলিকে ‘সাধারণের আবশ্যিক পরিষেবা’ (পাব্লিক ইউটিলিটি সার্ভিসেস) বলে ধরা হবে। শ্রম-বিরোধ আইনে রেল, মোটরপরিবহন, বিমান, পোর্ট/ডক, পোস্ট-অফিস, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন ইত্যাদি সংস্থা ‘সাধারণের আবশ্যিক পরিষেবা’ হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ বিনা নোটিশে ধর্মঘট করা যাবে না। সরকার ঘোষণা করেছেন ‘সেজ’এ সব ধরণের কর মকুব করা হবে, প্রথম ৫ বছর আয়ের উপর কোন কর লাগবেনা, পরবর্তী সময়ে কর হবে অর্ধেক। স্থাবর সম্পত্তি ও সেই সংক্রান্ত দলিলের উপর কোন স্ট্যাম্প ডিউটি লাগবে না। এখানে কারখানা করার উপযোগী জমির ভাড়া বছরে প্রতি বর্গ মিটার ২৫ টাকা। প্রথম ৫ বছরে বেশ কিছু ছাড় আছে। ফ্যাক্টরী শেডের ভাড়া বছরে প্রতি বর্গ মিটার ৪৬৫ টাকা থেকে ৯৭৫ টাকা পর্যন্ত। এখানে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে যথেষ্ট কম দামে। এছাড়া নতুন কোম্পানীদের, অথবা যারা রাত ১১টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ৫০ অশ্বশক্তির বেশী মেশিন চালাবে, তাদের ৫০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হবে। ২৪ ঘন্টা জল সরবরাহ, প্রতি ১০০০ লিটার জল ৪ টাকা দরে দেওয়া হবে। এখন হয়ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামান্য কিছু রেট বাড়তেও পারে। এখানে বানানো হয়েছে বৈদ্যুতিন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, অত্যাধুনিক জেটি ঘাট, বৈদ্যুতিন মাল ওজনের যন্ত্র, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, ফায়ার স্টেশন, চিকিৎসা পরিষেবা, টেকনিকাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, বহু স্টাফ কোয়ার্টার – আরো বেশ কিছু অফিস ও কোয়ার্টার নির্মিয়মান। সবচেয়ে মজার কথা, মালিকপক্ষের দায়িত্ব বা বাধ্যবাধকতা নিয়ে সরকার একটি শব্দও খরচ করেনি। এমনকি উৎপাদনকে যে রপ্তানিমুখী হতে হবে, তার কোন বাধ্যবাধকতার কথাও বলা হয়নি।
রাস্তাঘাট ও অন্য পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে কয়েকশ’ কোটি টাকা। ‘সেজ’-এর ভিতর কংক্রিটের ঝাঁ চকচকে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে প্রায় ২৫ কিলোমিটার। পরিকল্পনা আছে রাস্তা আরো দীর্ঘ হবে। আর আছে প্রায় ১২ ফুট উঁচু চতুর্দিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ও পাঁচিলের উপর লাগানো গোল করে কাঁটা তারের জাল, গেট-এ নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করছে ‘ফলতা স্পেশাল ইকনমিক জোন’। এর ভিতরে এক অন্য জগৎ, যেখানে শ্রমিককে আখ মাড়াই কলের মতো পিষে তৈরি হচ্ছে পুঁজির রসভান্ডার । যার জন্য প্রচলিত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে শ্রমিক শোষণ ও নিপীড়ন। এর বিরুদ্ধেই চেভিয়েটের শ্রমিকদের ন্যায্য লড়াই।
চেভিয়েটের শ্রমিকদের ন্যায্য লড়াই
চেভিয়েটের শ্রমিকদের কথায় ফিরে আসা যাক। ২০০৩-এর মার্চে চেভিয়েট কোম্পানী খোলার পর প্রায় প্রতি বছর কোম্পানীর উৎপাদন বেড়েছে, লাফিয়ে বেড়েছে মুনাফা। অথচ যথারীতি শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান বাড়ে নি। জুট শিল্পের ঘোষিত নিয়ম এখানে মানা হয় না। ওভারটাইম করিয়ে ‘সিঙ্গল রোজ’ দেওয়া হয়। অথচ ১২ ঘন্টা ডিউটি করলে পে-স্লিপে লেখা হয় ১০ ঘন্টা। অর্থাৎ কাগজেকলমে দেখানো হল, ওভারটাইমের রেট দ্বিগুণ। বহু শ্রমিকের কোন নিয়োগপত্র নেই। ছুটিছাটার কোন বালাই নেই। প্রায় ২৫০ জন শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৩৫ জন পার্মানেন্ট। ১৫-১৭ বছর কাজ করছেন এমন বহু শ্রমিককে আজও স্থায়ী করা হয় নি। কোন কোন ডিপার্টমেন্টে বাধ্যতামূলক ১২ ঘন্টা ডিউটি করে রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের গড় বেতন হল দৈনিক ২৬৬ টাকা থেকে ৩২১ টাকা। যখন তখন যেকোনো অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাই এখানকার একটি নিয়মে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ম্যানেজমেন্ট। স্বাভাবিক ভাবে এই বেনিয়ম, অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে।
২০১৭ থেকে শ্রমিকরা সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া নিতে শুরু করেন। অক্টোবর ২০১৭-তে স্থায়ী শ্রমিকরা প্রথম গড়ে তোলেন ‘চেভিয়েট কোম্পানী পার্মানেন্ট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন’। ২০১৮-র জানুয়ারীতে গড়ে ওঠে ঠিকা শ্রমিকদের ইউনিয়ন।
এরপর গত ফেব্রুয়ারী মাসে ম্যানেজমেন্টের কাছে দুটি ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দাবিসনদ দেওয়া হয়। নড়েচড়ে বসে ম্যানেজমেন্ট। তারা ভাবতেই পারে নি, শ্রমিকরা সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে নেবে, কোম্পানীতে দু-দুটি ইউনিয়ন গড়ে ফেলবে! ম্যানেজমেন্ট ভেবেছিল, এই আনপড়, ভুখা শ্রমিকদের যেভাবে যেমন খুশী চালিয়ে যতদিন ইচ্ছে শ্রম নিংড়ে নেওয়া ছিবড়ে করে দেওয়া যাবে। কেউ কেউ বেশী মাথা চাড়া দিলে মাছির মত টোকা মেরে গেটের বাইরে করে দেওয়া হবে। যেমন বিগত বছরগুলিতে হামেশাই করা হয়েছে।
ম্যানেজমেন্ট দাবিসনদ গ্রহণ করল না। অজুহাত তৈরি করে বলল, ডেভেলপমেন্ট কমিশনার(ডি.সি) বললে তবেই তা নেওয়া যেতে পারে। শ্রমিকরা ডি.সি-র কাছ থেকে জানলেন, এ রকম কোন নিয়ম নেই। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ম্যানেজমেন্ট দাবিসনদ গ্রহণ করল। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট থেকে মীমাংসার জন্য ইউনিয়নের সাথে আলোচনার জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় বলা হল না। শ্রমিকরাও নাছোড়বান্দার মত সরকারী দপ্তরে এসব জানাতে থাকলেন। ইতিমধ্যে ইউনিয়ন ভাঙ্গার জন্য ম্যানেজমেন্ট একটি ন্যাক্কারজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করল – কন্ট্রাক্ট ইউনিয়নের সভাপতিকে অন্যায় ভাবে ছাঁটাই করে দিল। ম্যানেজমেন্টের স্টাফ একজন শ্রমিককে চড় মারার প্রতিবাদ করেছিলেন ইউনিয়নের সভাপতি। সেই অজুহাতে ছাঁটাই-এর ঘটনা ঘটেছিল, যদিও তা ছিল ইউনিয়ন ভাঙ্গার একটি মালিকী চক্রান্ত। এই ঘটনায় জ্বলে উঠলেন শ্রমিকরা এবং সেই মুহূর্তেই একটা হেস্তনেস্ত চাইলেন। ইউনিয়নের দক্ষ নেতৃত্ব জানতেন, ফলতা ‘সেজ’ ‘পাব্লিক ইউটিলিটি সার্ভিস’-এর অন্তর্ভূক্ত। তাই তাঁরা ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ম্যানেজমেন্টকে ১৪ দিনের আগাম নোটিস দিয়ে ‘টুল ডাউন’-এর প্রোগ্রাম সহ এক দিনের বা লাগাতার ধর্মঘটের প্রোগ্রাম জানিয়ে দিলেন। অর্থাৎ চেভিয়েটের শ্রমিকরা তাঁদের পাল্টা দাপট দেখাবার রাস্তা নিতে যাচ্ছেন, ম্যানেজমেন্টকে তা স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিলেন। প্রসঙ্গত বলা যায়, ফলতা ‘সেজ’-এ এর আগেও ধর্মঘট বা ‘টুল ডাউন’-এর মত প্রোগ্রামে শ্রমিকরা সামিল হন নি, এমনটি নয়। ২০১২-তে ১ ও ২ নং জোনের শ্রমিকরা চার দিনের স্বতঃস্ফুর্ত ধর্মঘট করেছিলেন বা অন্য কারখানায় এক দিন / এক বেলার ধর্মঘট বা ‘টুল ডাউন’ প্রোগ্রাম করেছিলেন। কিন্তু সেই ঘটনাগুলি ঘটেছিল শ্রমিকশ্রেণীর স্বতঃস্ফুর্ত উদ্যোগে, যার রেশ মিলিয়ে যেতে বেশী সময় লাগে নি। ‘সেজ’-এর ইতিহাসে এই প্রথম সংগঠিত ভাবে স্বাধীন ধারায় শ্রমিকশ্রেণীর লড়াই অন্য নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ফলত সরকারী তৎপরতাও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে।
ম্যানেজমেন্টকে দেয় ইউনিয়নের আগাম নোটিস শুধু ম্যানেজমেন্টকে নড়ায় নি, টনক নড়ায় সরকারী দপ্তরেরও। এত দিন শ্রমিকরা ‘সেজ’-এর ডেভেলপমেন্ট কমিশনার এবং অ্যাসিসটেন্ট লেবার কমিশনারকে চিঠিপত্র পাঠাতেন বা কথাবার্তা বলতেন। আগাম নোটিসের প্রেক্ষিতে ডেপুটি লেবার কমিশনার(ডি.এল.সি.), বারুইপুর, দায়িত্ব নিয়ে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকলেন। মানে, শ্রমিকদের ক্ষোভ প্রশমিত করে যদি তাঁদেরকে ‘ম্যানেজ’ করা যায়। ডি.এল.সি.-র বক্তব্য ছিল, শ্রমিকরা যাতে ‘টুল ডাউন’-এর প্রোগ্রামে না যায়। তার জন্য এই অতি-তৎপরতা দেরীতে হলেও শ্রমিকদের চোখে পড়েছে। ইতিমধ্যে দুটি ত্রিপাক্ষিক ও একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকে চেভিয়েটের কন্ট্রাকটর পর্যন্ত অশোক কবিকে কাজে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বললেও, ম্যানেজমেন্ট এ ব্যাপারে অনড় মনোভাব প্রকাশ করেছে। আইনত কন্সিলিয়েশন প্রসেস বা মীমাংসার প্রক্রিয়া চলার সময় কাজ বন্ধ করা যায় না। ডি.এল.সি. অত্যন্ত চতুরতার সাথে কন্সিলিয়েশন প্রসেসটি লম্বা করে দিচ্ছিলেন, যাতে শ্রমিকরা প্রোগ্রাম নিলে আইনি প্যাঁচে আটকে যায়। এই শঠতা ধরতে শ্রমিকদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি। তখন ইউনিয়ন কন্সিলিয়েশন প্রসেসটি বন্ধ করার জন্য চিঠি দিয়ে ডি.এল.সি.কে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউটস অ্যাক্ট, ১৯৪৭-এর সেকসন ১২ (৪) ধারা লাগু করতে বলে। কেন শ্রমিকরা ১২ (৪) ধারা এখানে প্রয়োগ করতে বললেন? এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি বৈঠকে কোন ধরনের মীমাংসায় পৌঁছনো না যায়, তাহলে এই ইনভেস্টিগেশন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়ে বাস্তবত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কন্সিলিয়েশন অফিসার যথাযথ সরকারী দপ্তরে পুরো রিপোর্ট পাঠাবেন, যেখানে মীমাংসার জন্য কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন এবং কি কারণে মীমাংসায় পৌঁছনো গেল না, তার বিবরণ থাকবে। অর্থাৎ এখানকার প্রসেসটি বন্ধ হয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে শ্রম বিরোধ-এর বিষয়টি যাবে। কিন্তু গোড়া থেকেই ডি.এল.সি. মালিকপক্ষের হয়ে খেলতে নেমে পড়েছেন। ওনার মূল উদ্দেশ্য ছিল, যেভাবেই হোক কন্সিলিয়েশন প্রসেসটি ওনার হেপাজতে থাকুক। এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সময়ের অপচয় হোক। বারবার জানাবার পরও যখন ডি.এল.সি. ১২ (৪) ধারা এখানে প্রয়োগ করছিলেন না, তখন শ্রমিকদের নেতৃবৃন্দ সরাসরি ডি.এল.সি. অফিসে গিয়ে তাঁকে চেপে ধরলেন। তখন তিনি জানাতে বাধ্য হন, যে তিনি ১২ (৪) ধারা প্রয়োগ করবেন এবং দশ দিনের মধ্যে রিপোর্ট পাঠাবেন। শ্রমিকরা সেখানেই ডি.এল.সি.-কে জানিয়ে দেন, তাঁরা যে কোন দিন ‘টুল ডাউন’-এর প্রোগ্রাম করবেন।
অনেক মালিকী হ্যাপা, সরকারী অফিসারের বিভিন্ন কায়দাকানুন সামলে অবশেষে মালিকপক্ষের অন্যায়, বেআইনি এবং অনমনীয় আচরণের প্রতিবাদে শ্রমিকরা ‘টুল ডাউন’-এর প্রোগ্রাম সফল ভাবে সংগঠিত করলেন। এতে মালিকপক্ষের অনড় মনোভাবে যেহেতু চিড় ধরল না, অগত্যা আরও বৃহত্তর শ্রমিক আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন চেভিয়েটের লড়াকু শ্রমিকরা। শ্রমিকদের সাধারণ সভায় ২০শে জুলাই এক দিনের ধর্মঘটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল দুটি ইউনিয়নের নেতৃত্বে। ঐ সভায় শ্রমিকদের লড়াই করার উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মত। তার প্রতিফলন দেখা গেছে ২০শে জুলাই শুক্রবার। ২৩৫ জন শ্রমিকের মধ্যে ৫ জন কাজে ঢুকেছিলেন, যার মধ্যে ছিলেন দু’জন ড্রাইভার ও তিনজন বাগান-কর্মী। প্রত্যেকটি শিফটে ধর্মঘট সফল করলেন লড়াকু শ্রমিকরা। ফলতা ‘সেজ’-এ এই প্রথম এতটা সংঘবদ্ধ ভাবে শ্রমিকরা ধর্মঘট হল। তবে নির্লজ্জ ম্যানেজমেন্ট এর পরেও ছাঁটাই শ্রমিককে কাজে ফেরায় নি।
অতঃপর
তাই, চেভিয়েটের শ্রমিকরা আরও বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যাওয়ার জন্য সাংগঠনিক শক্তিকে সংহত করছেন। বর্তমানে চেভিয়েটের প্রত্যেক শিফটের শ্রমিকরা প্রতীকী প্রতিবাদ জারি রাখতে প্রতিদিন কালো ব্যাজ পরে কারখানায় কাজে ঢুকছেন। এখন প্রয়োজন এই অনন্য লড়াইয়ের পাশে থাকা।