মাথার উপর ছাদের দাবীতে রাজ্যের হবু ডাক্তাররা ১৩দিন অন্নহীন। আন্দোলনের সমর্থনে অনুষ্ঠিত হল গণকনভেনশান, বেরোল স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উঠল আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ। শুরু হল রাজনৈতিক নেতাদের আনাগোনা, ফটো অপ, মিডিয়া বাইট। এদিকে প্রত্যয়ী কিন্তু অসুস্থ অনশনকারী ছাত্রেরা। মঙ্গলবার, ২৪ জুলাই দুপুর ২টোয়, মেডিকেল কলেজ থেকে এস্পল্যানেড পর্যন্ত মহামিছিলের ডাক। গ্রাউন্ডজিরো প্রতিবেদন।
হস্টেলের সুষ্ঠু কাউন্সেলিঙের দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের অনশনের ১৩ তম দিনে মেডিকাল কলেজের জেনারেল লেকচার থিয়েটারে আজ, ২২ জুলাই বিকেল ৩.৩০ তে একটি গণকনভেনশনের আয়োজন করা হয়। কানায় কানায় ভরা থিয়েটার হলে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা পরিচালনা করেন প্রাক্তনী অর্ক বৈরাগ্য। উপস্থিত ছিলেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন পেশার মানুষ। চলচ্চিত্রকার কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, অনীক দত্ত, সঙ্গীতকার দেবজ্যোতি মিশ্র, বিমল চক্রবর্তী, কৌশিক সেনের মতো নাট্যব্যক্তিত্ব, সঙ্গীতশিল্পী পল্লব কীর্তনীয়া, মৌসুমী ভৌমিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, অরুনাভ ঘোষ, সমাজকর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায় উপস্থিত থেকে আন্দোলনের সংহতিতে বক্তব্য রাখেন। বক্তব্য রাখেন এপিডিআর-এর রঞ্জিত শূর, মেডিকাল কলেজেরই অধ্যাপক অর্ণব সেনগুপ্ত এবং বিভিন্ন ছাত্রছাত্রী আন্দোলন ও গণআন্দোলনের কর্মীরা ও অনেক সাধারণ ছাত্রছাত্রী। অনশনকারী অরিজিত বলতে উঠে খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেন নি।
সভা আগাগোড়াই বেশ উত্তপ্ত ছিল। হস্টেল কাউন্সেলিঙের মতো সহজ ও সঙ্গত দাবির মোকাবিলায় তের দিনে তিনজন অধ্যক্ষের আসাযাওয়াসহ কর্তৃপক্ষের আশ্চর্যজনক অনমনীয় আচরণ এবং শেষপর্যন্ত অনশনের ত্রয়োদশ দিনে এসে বারম্বার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিকে দায়িত্ব ঠেলে দেওয়ার হাস্যকর বীভৎসতায় সবাই ছিলেন অভিভূত। গতদিন অধ্যক্ষের প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল আত্মহত্যা-প্রচেষ্টার অপরাধে পুলিশ ঢুকতে পারে আন্দোলনে। তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে – অরুনাভ ঘোষের কথার সূত্রে – কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উঠে আসে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ। এতগুলো মানুষ – দেরিতে হলেও যাঁরা একজোট হয়েছেন একই উদ্দেশ্যে – সমস্বরে দাবি জানাতে থাকেন একটা আশু ফয়সালার জন্য। উপস্থিত জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশে আয়োজক ছাত্রছাত্রীরা বিহবল হয়ে পড়েন। কিছুজন ছাত্রদের সংহতিতে, অন্য কোনো প্রকাশ্য স্থানে গণঅনশনের কর্মসূচীর কথাও বলে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত সভা থেকে সিদ্ধান্ত হয় যে কনভেনশন শেষ হলে মেডিকেল কলেজ থেকে একটি মিছিলে হাঁটবেন সবাই। মঙ্গলবার, অর্থাৎ ২৪ জুলাই দুপুর ২টোয়, মেডিকেল কলেজ থেকে এস্পল্যানেড পর্যন্ত একটি মহামিছিলের ডাক দেওয়া হয়। ঠিক হয় সেখান থেকে রাজ্যপালের কাছে ডেপুটেশন দিতে যাওয়া হবে। তার জন্য সই সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে কনভেনশনের মধ্যেই। দাবি – সাদা চোখে দেখলে – খুব সামান্যই। কিন্তু সরকারপক্ষ যেভাবে গোটা বিষয়টাকে দেখছে তাতে দুটো জিনিস স্পষ্ট। প্রথমত, হস্টেলের দখল তারা রাজনৈতিকভাবে সরকারপন্থী ছাত্রছাত্রীদের দখলে রাখতে চায় – তা সে তাতে যতজন ন্যায্য দাবিদার হস্টেল পাক চাই না পাক, যে কারণে তারা হস্টেল সুপার হিসেবেও শাসকদলেরর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একজন অত্যন্ত জুনিয়র ও অযোগ্য (২০১৬-এ এমবিবিএস পাশ, যেখানে হোস্টেল সুপার সাধারণত কোনও অধ্যাপক অথবা বিভাগীয় প্রধানকে করা হয়ে থাকে) লোককে নিয়োগ দিয়েছে। দ্বিতীয় কথা হল, বিষয়টা এই মুহূর্তে খানিক ইগো ধরে রাখার লড়াইতেও পৌঁছে গেছে। সরকারপক্ষ থেকে বলাও হয়েছে যে কোনো চাপের কাছে তারা নতি স্বীকার করবে না। অর্থাৎ, ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লড়াইটা এখন শাসকবিরোধী ‘চাপ’ এ পর্যবসিত হয়েছে। দাবির প্রাথমিক ন্যায্যতাটা হয়ে পড়েছে গৌন। এ ইগোটিজম কাটিয়ে উঠতে না পারলে সামনে বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ক্রমশই আরো আরো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিকে ঠেলে দেবার ন্যক্কারজনক অজুহাত এখন যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছে পরিস্থিতি, তাতে একটি কলেজ হস্টেলের বোর্ডার বন্টনের নির্দেশ দিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া অন্য উপায় পাওয়া যাচ্ছে না। এ কীরকম অথরিটি? এ একনায়কত্বের শেষ কোথায়? আরো ভয়ানক কথা হল, আজ রবিবাসরীয় অনশন, কারণ রোববার বলে কোনো তথাকথিত অফিশিয়াল সিদ্ধান্ত আজ নেওয়া যাবে না। শেষ খবর অনুযায়ী রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা (শিক্ষা) মেডিকেল ছাত্রদের এই আন্দোলনকে ‘প্রতীকী অনশন’ বলে চিহ্নিত করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাতেও ছাত্রদের দাবি মানার সরাসরি প্রতিশ্রুতি এড়িয়ে, ‘বিষয়টি দেখা হবে’-র মতো ভাসা ভাসা বক্তব্য রেখে তাদের ‘প্রতীকী অনশন’ তুলে নিতে পরামর্শ দিয়েছেন।
যাই হোক, সভাশেষে বেশ বড় একটি মিছিল মেডিকেল কলেজ থেকে বেরিয়ে এমজি রোড হয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে বউবাজার ক্রসিং পেরিয়ে আবার কলেজে ফেরে। মিছিলে অন্তত শ’ পাঁচেক লোক ছিল। মিছিলে দল-মত নির্বিশেষে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। সারাদিনের বিভিন্ন সময় কবীর সুমন, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, উপল সেনগুপ্ত, শিলাজিত মজুমদার, সূর্যকান্ত মিশ্র প্রমুখেরাও আন্দোলনের সংহতিতে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা করেন। আসেন আগে তৃণমূল-এর, এখন বিজেপি-র মুকুল রায়। অনশনকারী ছাত্রেরা তাঁর সাথে কথা বলতে অস্বীকার করেন। কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে মুকুলবাবুকে অনশনস্থল থেকে খানিক দূরে একত্রিত মিডিয়া ক্যামেরাগুলিতে দীর্ঘ বক্তব্য রাখতে দেখা যায়।
ছবিঃ ভাস্কর প্রতিম মৈত্র