আর্মির গুলিতে মৃত ৩। বুরানি দিবস : ত্রালে কারফু, শ্রীনগর যেন অবরুদ্ধ নগরী। প্রাকৃতিক রোষে বাধা, তবু অমরনাথ দর্শনে ৮৩ হাজার।
দেবাশিস আইচ
পুলিশের-প্রশাসনের বক্তব্য খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। ৭ জুলাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুলিতে ২০-২২ বছরের দুই যুবক এবং এক ১৬ বছরের কিশোরীর মৃত্যু হয়। কাশ্মীরের সমস্ত প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যার নিন্দায় মুখর। নিন্দা করেছে ‘জয়েন্ট রেজিস্ট্যান্স লিডারশিপ’ বা জেআরএল নেতৃত্ব। এমনকি বণিক সভাগুলিও। বিজেপি অবশ্যই ব্যতিক্রম। কিন্তু সাংবাদিকের শিক্ষা বলছে, এ ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী বা পুলিশ-প্রশাসনের বক্তব্যটাও জানা জরুরি। অবশেষে পাওয়া গেল।
“কুলগাম জেলার হাউরা মিশিপোরা দিয়ে যাওয়ার সময় সামরিক বাহিনীর গাড়িতে ইট ছোঁড়া হয়। সামরিক বাহিনী দুষ্কৃতীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এই সময় পাঁচজন আঘাত পায়।
“তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আঘাতের কারণে এক বালিকা সহ তিনজন মারা যায়।
“পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।”
অতি সরল একটি ঘটনা। মৃত্যু কত সহজ, জীবন কত সস্তা। গা শির শির করে ওঠা প্রশাসনিক নিঃস্পৃহতা। ইটের বদলে বুলেট ফুঁড়ে দিতেও আর পিছপা নয় জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন। সামরিক বাহিনী যে গুলি চালিয়েছে, সে তথ্যটুকু সরকারি ভাবে জানানোর কোনও প্রয়োজন মনে করা হয়নি। সংবাদপত্র রাইজিং কাশ্মীর অবশ্য জানাচ্ছে, জঙ্গিরা লুকিয়ে রয়েছে সন্দেহে সেনাবাহিনী ওই এলাকা ঘিরে ফেলছিল, সেই সময় স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে মৃত আন্দলিব জান, ইরশাদ আহমেদ লোনে ও সাবির আহমেদ খান্দের শরীরে বুলেটের আঘাত ছিল। অর্থাৎ, বাধা পেলে ইটের বদলে বুলেট ফুঁড়ে দিতে পিছপা নয় নিরাপত্তা বাহিনী। হুরিয়াত কনফারেন্স (জি) নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি, হুরিয়াত কনফারেন্স (এম) চেয়ারম্যান মিরওয়াজ মৌলভি ওমর ফারুক, জেকেএলএফ-এর চেয়ারম্যান মহম্মদ ইয়াসিন মালিকদের নেতৃত্বাধীন জেআরএল-এর ভাষায়, “সশস্ত্র হোক কিংবা নিরস্ত্র, কাশ্মীরিদের মুছে ফেলার সবুজ সংকেত সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে, এটা পরিষ্কার।”
বুরহান দিবস
না, এখানেই ঠিক শেষ নয়। আজ হুরিয়েত কনফারেন্সের ডাকা বন্ধে উপত্যকা স্তব্ধ। রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী যেন এক অবরুদ্ধ নগরী। প্রশাসন পুরোনো শ্রীনগরের নওহাট্টা সহ পাঁচটি থানা এলাকা তারকাঁটার বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। প্রধান প্রধান রাস্তায় ব্যারিকেড। অন্য দুটি থানা এলাকায় কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল। শুক্রবার ঐতিহাসিক জামা মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে দেয়নি প্রশাসন। জামা মসজিদ এলাকায় নিরাপত্তা আরও কঠোর। হুরিয়ত নেতারা হয় গৃহবন্দি অথবা তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করে থানায় আটক করে রাখা হয়েছে মহ. ইয়াসিন মালিককে। অন্যান্য জেলা শহরগুলিও নিরাপত্তার বলয়ে ঢাকা। বন্ধ রাখা হয়েছে ট্রেন চলাচল। মোবাইলের ইন্টারনেট প্রশাসনিক নির্দেশে বন্ধ। ফিক্সড লাইনের ব্রড ব্যান্ডের স্পিড কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ আজ ‘বুরহান দিবস’।
বুরহানের জন্ম-শহর ত্রালে শনিবার থেকেই কারফু জারি করা হয়েছে। ত্রালে মাছিও ঢুকতে দিতে রাজি নয় প্রশাসন। কাক-পক্ষীরাও যাতে বাসা থেকে বেরোতে না-পারে সে বিষয়ে চরম সজাগ নিরাপত্তা বাহিনী। ২০১৬ সালের ৮ জুলাই নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানি সহ দুজনের মৃত্যু হয়। এর পরেই সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে কাশ্মীর উপত্যকা। লাগাতার বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে কমপক্ষে ৯০ জন বিক্ষোভকারী মারা যান। বৃদ্ধ হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি গিলানি থেকে বহু কাশ্মীরি তরুণের কাছেই বুরহান ‘রোল মডেল’। তার মৃত্যু তাদের ‘সযত্নে লালিত আন্দোলনে আলোর হাতছানি’। আজ এই হিজবুল কমান্ডারের মৃত্যুর দ্বিতীয় বার্ষিকী।
যাত্রীরা আমাদের অতিথি : হিজবুল
এদিকে পুলিশ-প্রশাসনের নানা আশঙ্কা, ফেক নিউজের প্ররোচনা সত্ত্বেও প্রথম দশদিনে ৮৩ হাজার ১৩০ জন পুণ্যার্থী অমরনাথ মন্দির দর্শন করেছেন। এ বছর রেজিস্ট্রিকৃত যাত্রীর সংখ্যা ২,১১,৯৯৪ জন। ৪ জুলাই বালতাল রুটে ধস নামায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়। আটকে পড়া ৫৬৭ জন যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর ফলে তিনদিন বন্ধ থাকে বালতাল রুট। পহেলগাঁও দিয়ে অবশ্য যাত্রা হয়েছে। অন্যদিকে, যাত্রার একদিন আগেই হোয়াটসএপে একটি ছবি ভাইরাল হয়ে ওঠে। ছবিটিতে দেখা যায়, ডেমোক্র্যাটিক ফ্রিডম পার্টি বা ডিএফপি’র লেটার হেডে কাশ্মীরি মুসলমানদের কাছে ‘বিধর্মীদের তাড়িয়ে দেওয়ার’ আবেদন জানানো হচ্ছে। চিঠির তারিখ ২৫ জানুয়ারি, ২০১৫। অর্থাৎ, চিঠিটি আবার নতুন করে পোস্ট করা হয়েছে। ডিএফপি’র প্রতিষ্ঠাতা হুরিয়ত নেতা সাবির শাহ গত ৩১ বছর জেলবন্দি। খতিয়ে দেখা যাচ্ছে, লেটার হেডটিই ভুয়ো। পাশাপাশি, অশুদ্ধ ইংরেজিতে লেখা চিঠিটি লেটার হেডের মার্জিন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। অমরনাথ যাত্রা বা কাশ্মীর নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে এমন মিথ্যা ছবি ও খবর নতুন নয়। এক সময় তীর্থযাত্রীদের ইট ছুঁড়ে মারা হচ্ছে বলে একটি ভুয়ো ছবি এমনই ছড়িয়ে পড়েছিল।
বেশ কয়েক বছর হল অমরনাথ যাত্রা যেন একটি সামরিক সজ্জায় সজ্জিত তীর্থযাত্রা। তার সঙ্গে জোট বেঁধেছে আরও বেশি বেশি করে পুণ্যার্থী কাশ্মীরে টেনে নিয়ে যাওয়ার উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রতিযোগিতা। প্রতি বছরই তীর্থযাত্রীদের জঙ্গিরা আক্রমণ করবে এমন এক আশঙ্কার খবর কী রাজ্য কী কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে ছড়িয়ে পড়ে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে এমনই এক আশঙ্কার কথা শুনিয়েছিলেন রাজ্যের ডিজিপি এস পি বৈদ। এবার অবশ্য জঙ্গিদের তরফ থেকে পালটা বার্তা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘অমরনাথ যাত্রীরা আমাদের লক্ষ্য নয়। ওঁরা এখানে ওঁদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে আসেন। ওঁরা আমাদের অতিথি।’ হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার রিয়াজ নাইকু যাত্রা শুরুর আগেই ডিজিপি’র বক্তব্যের প্রতিবাদ করে সামাজিক মাধ্যমে তাঁর বক্তব্যের অডিও ক্লিপ প্রচার করেন। সেখানে তাঁকে বলতে শোনা যায়, “আমরা যাত্রীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমাদের যুদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে যারা আমাদের বন্দুক তুলে নিতে বাধ্য করেছে।… আমাদের যুদ্ধ ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের বিরুদ্ধে নয়।”
এ বছর রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়ার কারণে অমরনাথ যাত্রার নিরাপত্তার মূল দায়িত্ব নিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। রাজ্য ও জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের দায়িত্ব কমিয়ে বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীকে। সামরিক ব্যবস্থা তদারকি করে গিয়েছেন স্বয়ং কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সীতারামন। উপত্যকায় কারফু ও বন্ধের কারণে রবিবার অবশ্য জম্মু শিবির থেকে তীর্থযাত্রা স্থগিত রাখা হয়। বালতাল ও পহেলগাঁও থেকে যাত্রা হয়েছে বলে সংবাদসংস্থা জানিয়েছে।
এখন জম্মু-কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতি শাসনের বকলমে মোদী-রাজনাথ-ডোভাল-মাধবের শাসন। ‘রাইজিং কাশ্মীর’-এ ৭ জুলাই-এর এক সম্পাদকীয় নিবন্ধের মন্তব্য থেকেই বর্তমান ছবিটি যে অতীতের নীতি অনুসারী তা পরিষ্কার। “ক্রুদ্ধ তরুণদের কথা শোনার বদলে সরকার তাদের মুখের উপর সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা সম্পূর্ণ খারিজ করে দিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ফলত পরিস্থিতির সেই চক্রাকার পুনরাবৃত্তি। আরও বেশি প্রতিবাদ, বিক্ষোভ এবং হাঁটুতে কাঁপুনি ধরা সরকারি প্রতিক্রিয়া।”
সৌজন্য : রাইজিং কাশ্মীর ও ফ্রি প্রেস কাশ্মীর | ছবি : ওয়ানডে ম্যাগাজিন