গণি খান চৌধুরী ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (জি.কে.সি.আই.ই.টি) মালদায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ একটি কলেজ। সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা ডিগ্রী-রেজাল্ট-পড়াশুনার সুযোগের বদলে পেয়েছেন প্রতারণার পর প্রতারণা, দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন এক অন্ধকার ভবিষ্যতের মুখোমুখি। হার না মানা ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের কথা লিখেছেন সাইন জাহেদী।
ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত মড্যুলার প্যাটার্নে চলা কলেজগুলির মধ্যে গণি খান চৌধুরী ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (জি.কে.সি.আই.ই.টি) চার নম্বর। ২০১০ সালে সোনিয়া গান্ধী এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর উদ্বোধন করেন। মড্যুলার প্যাটার্ন হওয়ার সুবাদে এখানে মাধ্যমিক পাশের পর ভর্তি হলেই ক্রমান্বয়ে প্রথমে দুই বছরের ক্লাস টুয়েলভের সমতুল্য ডিগ্রী, দুই বছরের ডিপ্লোমা ও দুই বছরের বি.টেক. কোর্স পড়ানোর পর উচ্চশিক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের অল ইন্ডিয়া এনট্র্যান্স টেস্ট (এ.আই.ই.টি.)-এর মাধ্যমে ভর্তি নেওয়া হয়। ২০১৪ সালে এই কলেজে রাষ্ট্রপতি আসেন কলেজের নতুন ভবন উদ্বোধন এবং তার সঙ্গে বি.টেক. কোর্সের উদ্বোধন করতে। ২০১৬ সালে আমাদের বি.টেক. কোর্স শেষ হয়। সার্টিফিকেট চাইতে গিয়ে আমরা জানতে পারি কলেজটি অ্যাফিলিয়েটেড-ই নয়, অর্থাৎ তারা কোনোরকম সার্টিফিকেট প্রদান করতে পারবে না। এক অর্থে এটি একটি ভুয়ো কলেজ।
ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে বসেন। ২৬দিন ধরে চলে অনশন। জাতীয় সড়ক অবরোধ ও রেল ব্লকের কার্যসূচিও নেওয়া হয়। অবশেষে রাজ্য সরকার ডিপ্লোমা পর্যন্ত অ্যাফিলিয়েশন দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। বি.টেক.-এর অ্যাফিলিয়েশন দুর্গাপুর এন.আই.টি. দেবে বলে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক চিঠির মাধ্যমে জানায়। পুরো ব্যাপারটা মালদার অতিরিক্ত জেলাশাসক, রাজ্য টেকনিক্যাল কাউন্সিলের ও.এস.ডি. ও কলেজ-কর্তৃপক্ষ সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতিতে ঘোষণা করেন। রাজ্য সরকারের কথামতো পরবর্তীতে রাজ্য টেকনিক্যাল কাউন্সিল পাশ করে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের সার্টিফিকেট প্রদান ও সার্টিফিকেট কোর্স থেকে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তিও নেয়। কিন্তু দুর্গাপুর এন.আই.টি. কর্তৃপক্ষ তাঁর দেওয়া কথা থেকে সরে আসেন এবং কোনো ছাত্রছাত্রীকেই সার্টিফিকেট প্রদান বা ভর্তির ব্যবস্থা করা হয় না।
২০১৭ সালে কলেজের আধিকারিক (ইন-চার্জ) ও জি.কে.সি.আই.ই.টি.-র মেন্টর-ডিরেক্টর বি.টেক. কোর্সের ক্লাস ও ভর্তি প্রক্রিয়া মাঝরাস্তায় বন্ধ করে দিলে ছাত্ররা বাধ্য হয়ে অ্যাফিলিয়েশন-এর বার্তা নিয়ে আসা মালদার অতিরিক্ত জেলাশাসকের কাছে যান। অতিরিক্ত জেলাশাসক ছাত্রদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেন, কিন্তু ব্যাপারটি কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের অধীন হওয়ায় তিনি এই বিষয়ে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। ছাত্রছাত্রীরা আরো একবার প্রতারিত হয়ে এক অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
ঐ বছরই কলেজ-কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে ডিপ্লোমা ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের ফাইনাল সেমেস্টার পরীক্ষা শেষ হয় ডিসেম্বর মাসে, যেখানে কিনা আদতে ঐ পরীক্ষা জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। ফলে বি.টেক. কোর্সে অন্যত্র সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ছাত্রছাত্রীরা ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এই বঞ্চিত ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের পড়াশুনা জীবনের একটা বছর বাঁচানোর উদ্দেশ্যে এবং মড্যুলার প্যাটার্নের নিয়ম অনুযায়ী জি.কে.সি.আই.ই.টি.-তেই ভর্তির দাবিতে আন্দোলনে নামলে আন্দোলনের কয়েকদিনের মাথায় কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের লিখিত আশ্বাস দেন, যে মার্চ ২০১৮ নাগাদ এম.এ.কে.এ.ইউ.টি. থেকে অ্যাফিলিয়েশন পাওয়া যাবে ও সেই সময় ছাত্রছাত্রীদের একটি লেট সেমেস্টার শুরু করা হবে। মাঝের সময়টুকু ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁদের জন্য হরিয়ানাতে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হবে। অথচ ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে এই কথার সম্পূর্ণ উল্টোদিকে গিয়ে কলেজ-কর্তৃপক্ষ ডিপ্লোমা পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের সাফ জানিয়ে দেন, যে কলেজ কোনোরকম ট্রেনিং করাতে পারবে না। কেউ যদি তারপরেও ট্রেনিং করতে চায় তাহলে তাকে ট্রেনিং-খরচা বাবদ কর্তৃপক্ষকে ১৫,০০০ টাকা দিতে হবে। ছাত্রছাত্রীরা আবারও একবার প্রতারিত হন, কিন্তু এবার তাঁরা শুধুমাত্র মার্চে ভর্তি হবেন সেই আশায় আন্দোলনে না গিয়ে চুপ করে থাকতে বাধ্য হন।
২০১৮-এর মার্চ মাস কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে যাঁদের একবছর নষ্ট হয়েছে, সেই ছাত্রছাত্রীদের জন্য বহু প্রতীক্ষার পর একটি আশার মাস ছিল। কিন্তু কলেজ-কর্তৃপক্ষ মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে এই ব্যাচের কিছু ছাত্রকে ডেকে জানান, যে জি.কে.সি.আই.ই.টি. এখনো অ্যাফিলিয়েটেড হয়নি। তাই তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি নিতে পারছেন না। কবে অ্যাফিলিয়েশন হবে, সেটাও তাঁদের অজানা। এ সত্ত্বেও ছাত্রছাত্রীরা কর্তৃপক্ষকে আরো দু’মাস সময় দেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এবারও ব্যর্থ। জুনের ১ তারিখ জানানো হয়, যে জমি সংক্রান্ত সমস্যার জন্য কলেজের অ্যাফিলিয়েশন হচ্ছে না এবং ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। সাথে সাথে এটাও পরিষ্কার হয়ে যায়, যে কর্তৃপক্ষের দোলাচলে এবছরের ডিপ্লোমা ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের সেমেস্টারও গত বছরের মতোই দেরিতে শেষ হবে।ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের পড়াশুনার ভবিষ্যতকে খুন হতে দেখে এবার আর চুপ থাকেননি। তাঁরা আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করেন। কর্তৃপক্ষ তাঁদের ন্যায্য দাবি পূরণ করতে না পারলেও তাঁদের আন্দোলন থেকে সরানোর কাজে দক্ষতার সঙ্গে লেগে পড়েন। বহু ছাত্রছাত্রীকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, পরীক্ষায় ফেলের ভয়, বাড়িতে ফোন করার ভয় দেখানো হতে থাকে। কিন্তু আন্দোলন আরো জোরদার হয়।
৪ জুন, ২০১৮। ছাত্রছাত্রীরা বি.টেক. কোর্সের অ্যাফিলিয়েশন, অ্যাপ্রুভাল ও সমস্ত ব্রাঞ্চের ছাত্রছাত্রীদের বি.টেক.-এর দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তির দাবিতে কলেজের প্রধান আধিকারিক ডিরেক্টরের অফিসের প্রধান ফটকের সামনে ধর্নায় বসেন। তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ‘দিল্লিতে আছি’ বলে দাবি করা ডিরেক্টর কলেজে আসেন এবং সমস্ত শিক্ষকের সঙ্গে মিটিং করে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের জানান, যে জমি সংক্রান্ত জট মিটে গেছে এবং অ্যাফিলিয়েশন নাকি দ্রুতই হয়ে যাবে, তাই তাঁদের আন্দোলন থেকে সরে আসা উচিত। অথচ পুরোনো ছাত্রছাত্রীদের বি.টেক.-এ এই কলেজেই ভর্তির ব্যাপারটি তিনি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে লিখিত আশ্বাস চাইলে কর্তৃপক্ষ তা নাকচ করেন, অতএব ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন জারি রাখেন।
আন্দোলনের ৬ দিনের মাথায় কর্তৃপক্ষ জানায় যে জি.কে.সি.আই.ই.টি.-এর লিখিত অ্যাফিলিয়েশন মিলেছে রাজ্য সরকারের কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এম.এ.কে.এ.ইউ.টি.-প্রদত্ত কাগজ ছাত্রছাত্রীরা দেখলে দেখা যায় সেখানে পুরনো ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির ব্যাপারে কোনো কথা লেখা নেই। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নীরব থাকেন।
টানা ১১ দিন রাত-দিন কলেজ গেটে অবস্থান বিক্ষোভের পর ছাত্রছাত্রীরা বাধ্য হয়ে অনশনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমদিন চারজন ছাত্র অনশন শুরু করেন। পরের দিন আরেকজন আন্দোলনকারী ছাত্র অনশনে বসেন। এই গ্রীষ্মে টানা অনশন চলার ফলে একের পর এক অনশনকারী ছাত্র অসুস্থ হতে থাকেন। তারপরেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। ছাত্রছাত্রীরা বাধ্য হয়ে কলেজের ডীন (একাডেমিক)-কে ঘেরাও করেন। ঘেরাওয়ের ৫ ঘন্টা পরেই ছাত্রছাত্রীদের দাবি পূরণে ব্যর্থ ডীন আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের এড়িয়ে পালিয়ে যান।
অনশনের ১৩-তম দিনেও ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবি পূরণে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী না হওয়ায় আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা কলেজের গণ্ডী পেরিয়ে তাঁদের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামেন, মালদা শহরে মিছিল করে তাঁদের দাবি-দাওয়া নিয়ে জেলাশাসকের কাছে উপস্থিত হন ও তাঁকে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ করেন। জেলাশাসক ব্যাপারটা দেখবেন বলে আশ্বাস দেন। অনশনের ১৫-তম দিনে হঠাৎ কলেজের ডিরেক্টর ও অতিরিক্ত জেলাশাসক কলেজে উপস্থিত হন ও অনশনকারীদের নিয়ে আলোচনায় বসবেন বলে জানান। কলেজ কর্তৃপক্ষ, অতিরিক্ত জেলাশাসক ও পুরাতন মালদা থানার আই.সি. এবং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর জেলাশাসক ও কলেজ কর্তৃপক্ষ অনশনকারীদের তাঁদের বি.টেক.-এর দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তির ব্যাপারে করা বিভিন্ন চিঠি ও কাগজপত্র দেখান এবং সভার বিবরণীতে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি নেওয়া হবে বলে লিখে সেখানে সকলে মিলে সই করেন। অতিরিক্ত জেলাশাসক ও কলেজের ডিরেক্টর সমস্বরে এ-ও জানান, যে পুরনো কর্তৃপক্ষ যে প্রতারণা করেছেন, তা ভুলে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা যেন তাঁদের উপর বিশ্বাস রাখেন এবং অনশন থেকে সরে আসেন।
আমরা জি.কে.সি.আই.ই.টি.-এর সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আমাদের আগামী ৪ জুন থেকে তৃতীয় সেমিস্টার পরীক্ষার কথা ভেবে, ও বহুবার বিশ্বাস ভাঙার পরেও অতিরিক্ত জেলাশাসকের কথায় আরো একবার বিশ্বাস রেখে, আন্দোলন থেকে না সরলেও, আপাতত কয়েকদিনের জন্যে অনশনের ১৬-তম দিনে এসে শুধুমাত্র অনশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। কলেজ-কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের প্রতারণার ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তবু, এই অন্ধকার ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়েও, আমরা শেষবারের মতো দেখতে চাইছি তাঁরা তাঁদের কথা রাখেন কি না, যদিও ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে এফ.আই.আর. পর্যন্ত করা হয়েছে।
যদি এবারেও আমাদের ন্যায্য দাবি অনুযায়ী বি.টেক. দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি না করানো হয় এবং কোনো হতাশ ছাত্র বা ছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, এই প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার দায় কি জি.কে.সি.আই.ই.টি.-কর্তৃপক্ষ তথা প্রশাসন নেবে? সাধারণ জনগণ কি শুধুমাত্র তখনই আমাদের পাশে দাঁড়াবেন? নাকি আরো একবার, এই মৃত উপত্যকার দেশে আরো কিছু তরুণ নাগরিককে খুন হতে দেখেও, সেদিনও, তাঁরা চুপ থাকবেন?
ছবি – আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সোশ্যাল মিডিয়া পেজ থেকে