সিদ্ধার্থ বসু
অবাধে চলছে গো-রক্ষা-ধর্মরক্ষার নামে ভারতীয় মুসলমানদের উপর অত্যাচার – হেনস্থা, ধর্ষণ, খুন। সরকারি মদতপুষ্ট এই হত্যালীলার আরও দুই শিকার হাপুর জেলার কাসিম ও সামিউদ্দিন।
আমাদের ভিতর থেকে – ধর্মের, জাতের, ভাষার চক্কর কেটে – অপর তৈরির খেলা চলছে বড় কম দিন হল না। কে কী খাবে, কী পরবে, কার থানে মাথা ঠুকবে, থেকে শুরু হয়ে দেশের কোন ইতিহাস-কোন ভূগোলের নির্মাণ সে জানবে, কোন বিজ্ঞানপ্রভ মন নিয়ে বিচার করবে নিজেকে আর নিজের পরিপার্শ্বকে, পরম্পরাকে – সবই আজ শাসকের হাতে, শাসকপ্রণোদিত গণহিস্টিরিয়ার হাতে। আখলাকের কথা আমরা ভুলিনি। জুনেইদ আমাদের বুকে বিঁধে আছেন। রোহিত ভেমুলা নাড়িয়ে দিয়ে গেছেন গোটা দেশের মানুষী বিবেক। তারপরেও রচিত হয়ে চলেছে একের পর এক বিয়োগনাট্য। কাফিল খান ও তাঁর ভাইয়ের দগ্ধাদৃষ্ট জ্বলজ্বল করছে। আসানসোলের ইমাম রশিদি ও তাঁরা মরা ছেলেকে নিয়েও রঙ্গতামাশা হয়েছে অবাধে। একইভাবে আসিফার ঘটনার তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়ায় মেটেবুরুজ আদি একাধিক ভিত্তিহীন রটনার বাজারিকরণ হয়ে গ্যাছে। সামাজিক মাধ্যমের অবিশ্বাস্য হারে বাড়তে থাকা ক্ষমতার দাপট পরিস্থিতিকে দ্রুত বিপজ্জনক করে তুলেছে আরো। শিখ পুলিশ অফিসার, মুসলমান যুবককে গণপ্রহার থেকে বাঁচালে প্রত্যাশামতো তাঁরই চরম হেনস্থা হয়েছে। বেচারা বোকাসোকা ট্রেনযাত্রী অন্যধর্মীয় এক যুবককে প্রধানমন্ত্রীর নাম, বন্দেমাতরম বলতে বাধ্য করা এবং তার নিরীহ অকৃতকার্যতায় তাকে মর্মান্তিক হেনস্থা করা – সবই চলছে।
এরই মধ্যে গত ১৮ জুন দিল্লীর কাছে, হাপুর জেলার পিলাখুয়া অঞ্চলে গণপিটুনির শিকার কাসিম নামের এক পশুব্যবসায়ী তেষ্টার জলটুকুও না পেয়ে জনতার চোখের ওপর মারা গেলেন। পুরো ঘটনার ভিডিও পাওয়া যায়, যেখানে ক্ষিপ্ত গো-মাতা-পূজারীরা তেষ্টায় কাতরাতে থাকা কাসিমের উদ্দেশ্যে উত্তপ্ত গালিগালাজ করছেন। ভিডিওতে কাউকে বলতে শোনা যায় যে আরেকটু দেরি হলে গরুগুলোকে নাকি আর জ্যান্ত পাওয়া যেত না। সকলের মুখ দেখা ও গলার স্বর শোনা গেলেও পুলিশ অসনাক্ত আততায়ীর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে।
কাসিম ছাগল ও মোষ কেনাবেচা করতেন। একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন পেয়ে তিনি ষাটহাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোন। তিনি তাঁর ব্যবসাসংক্রান্ত কাজেই বেরিয়েছিলেন বলে পরিবারের লোকেরা মনে করেন। এর অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁর প্রহৃত হবার খবর আসে। মুসলিমপ্রধান মাদাপুর গ্রাম থেকে পাঁচ কিমি দূরে সিদ্দিকপুরে কাসিম থাকতেন। পরেরদিন হিন্দুপ্রধান বাঘেরা খুর্দ থেকে যুধিষ্ঠির সিং এবং রাকেশ শিশোদিয়াকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। যে আখখেতের মধ্যে কাসিমকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল, তার কাছেই সামিউদ্দিন নামে আরেকজন ষাটোর্ধ প্রৌঢ়ের ওপরও হামলা হয়। তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। মাদাপুরে তাঁর বাড়ি। পুলিশ সুপার শর্মার বয়ান অনুযায়ী সামিউদ্দিনের ভাই ইয়াসিন এফআইআর-এ বলেন যে ঘটনার কারণ মোটরবাইক সংঘর্ষ ও সেই সংক্রান্ত গোলমাল, যা ঘটে আসলে কাসিমের সাথে অভিযুক্তদের মধ্যে এবং সামিউদ্দিন ঘটনাচক্রে এর মাঝে পড়ে যান। হয়তো তিনি ঝামেলা আটকাতে গিয়েছিলেন। সামিউদ্দিন তাঁর গোরুর খাবার কিনতে ওই অঞ্চলে গিয়েছিলেন – এমন কথাও তাঁকে বলতে শোনা যায়।
কিন্তু এই ইয়াসিনের মুখ থেকেই পরে জানা যায় যে গোটা ঘটনাটা আসলে গরু-জবাইএর বিরুদ্ধে গো-মাতা ভক্তদের তৈরি-করা হিংসার ফল। ইয়াসিন বলেন যে পরিস্থিতির চাপে তিনি পুলিশের কাছে সত্য গোপন করেছিলেন। অভিযুক্তদের পরিবার থেকেও এ ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায়। বাঘেরা খুর্দের সুধীর রানা বলেন যে সোমবার সন্ধে থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত পুলিশ তাঁদের হেপাজতে, দেবী মন্দিরে দুটি গরু ও একটি বাছুর রেখে যায়। যুধিষ্ঠিরের দাদা রামকুমার বলেন যে, কাসিম আক্রান্ত হবার জায়গা থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে অবস্থিত এই দেবী মন্দিরের কাছে কোনো গরু জবাই হচ্ছে – এরকম খবর যায় তাঁদের কাছে। এ থেকে অনুমান করা চলে যে এ জাতীয় গুজব রটিয়ে অঞ্চলে দ্রুত হিংসা ছড়ানো হয়েছিল। এবং উল্লেখ্য যে, বাইক চলার মতো কোনো রাস্তাও ওই অঞ্চলে পাওয়া যায় না। যার থেকে মনে হয় গরু-জবাই সংক্রান্ত হিংসার আস্ফালনকে ঢেকে রাখতেই বাইক-সংঘর্ষের গল্প বানানো হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর কারক হিসেবে অনিচ্ছায় বা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছায় ছড়ানো গুজবের ধ্বংসাত্মক ভূমিকার কথা মনে করলে পরিস্থিতিকে আরো জটিল বলে মনে হয়। পুরনো সময়ের দেশভাগপূর্ব ও স্বরাজোত্তর ছোটবড় ও প্রকাণ্ড দাঙ্গাগুলি থেকে শুরু করে হালের অযোধ্যা কাণ্ড, গোধরা গণহত্যা এবং এমন আরো অসংখ্য ক্ষেত্রে গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা বাঁধানো হয়েছিল।
সবকিছুর শেষে যোগ হয়েছে আরেকটি ভিডিও কেলেঙ্কারি। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর পরের একটি ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ্যে আসে, যেখানে অর্ধমৃত প্রহৃত ভিক্টিমকে দুহাত বেঁধে খোলা রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে চলেছে পুলিশ। তাদের বয়ানমতো, তাঁকে তারা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল, এবং এম্বুলেন্সের অনুপস্থিতির কারণেই ওই অভিনব পদ্ধতির প্রয়োগ। যাই হোক, উত্তরপ্রদেশ পুলিশ পরে এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে, এবং দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সামিউদ্দিন হাসপাতালে এখনো একটা নতুন জীবনের জন্য প্রাণপণ লড়ছেন।
We are Sorry for the Hapur Incident.
Law & order incidents often lead to unintended yet undesirable acts. pic.twitter.com/w5Tsen9UxG— UP POLICE (@Uppolice) June 21, 2018
ভিডিও : The Logical Indian