প্যালেস্তিনিয় আরবদের মনুষ্যত্বকে বাইরের লোকচক্ষু থেকে আড়াল করে রাখার মাধ্যমে “প্যালেস্তিনিয় আন্দোলন একটি আতঙ্কবাদী আন্দোলন” – এই প্রচার সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে এসেছে ইজরায়েল–আমেরিকা যৌথশক্তি। আরবরা যেহেতু ঠিক মানুষ নয়, কাজেই তাদের ক্ষেত্রে মৌলিক মানবাধিকার–ও প্রযোজ্য নয় – এই মত ইজরায়েল ও আমেরিকা উভয়-এর। অথচ একইসঙ্গে অন্যদিকে ইজরায়েল–এর সর্বাঙ্গীণ অধিকার আছে একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে অধিষ্ঠান করার, অধিকার আছে খোলাখুলি প্যালেস্তাইনের উপর হামলা চালিয়ে যাওয়ার। গাজার লাখ লাখ নিরস্ত্র মানুষের উপর ঘটে চলা অবিরাম ইজরায়েলি হানা ও গণহত্যা এবং তার রাজনৈতিক– অর্থনৈতিক – সামাজিক – সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে লিখছেন সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত। এটি প্রথম কিস্তি।
প্রেক্ষাপট
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খবরের দুনিয়ার অন্যতম বড় খবর হ‘ল হাজার হাজার প্যালেস্তিনিয় সাধারণ মানুষের উপর ইজরায়েল–এর গত বেশ কিছু সপ্তাহব্যাপী নির্বিচার বোমাবর্ষণ। সাম্প্রতিককালে এইটি–ই প্যালেস্তিনিয় আরবদের উপর ইজরায়েল–এর ৭০ বছর ব্যাপী আগ্রাসনের নতুনতম পর্যায়। প্যালেস্তিনিয় প্রতিরোধের তথাকথিত “গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন” অথবা “ঘরে ফেরার মহাযাত্রা” নামক অহিংস গণআন্দোলনের উপর প্রায় সারা পৃথিবীর ক্যামেরার সামনে এই হামলা চালায় ইজরায়েল। কিছু রিপোর্ট অনুযায়ী, এই দফায়, ৩০ মার্চ থেকে ১৫ মে–র মধ্যে, ইজরায়েলি আক্রমণে কম ক‘রে ১১২ জন বস্তুত নিরস্ত্র প্যালেস্তিনিয় আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে, এবং প্রায় ১২০০০ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৩ জন খুন হন ১৪ই মে, ইজরায়েলি “স্বাধীনতা দিবস“-এর দিন। ইজরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন B’Tselem এবং অন্য বেশ কিছু রিপোর্ট অনুযায়ী এই আক্রমণ ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। এমনকি ৩১শে মার্চ ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র নিজে টুইট করে বলেন যে, “কোনও কিছুই অনিয়ন্ত্রিতভাবে করা হয়নি, সবকিছুই ছিল নিখুঁত ও মাপজোক মাফিক। আমরা জানি কোন কোন বুলেট কোথায় কোথায় গিয়ে বিঁধেছে।“ পরে অবশ্য এই টুইট সরিয়ে নেওয়া হয়। ট্যাঙ্ক এবং ড্রোণ ছাড়াও বর্ডারে মোতায়েন ছিল ১০০ জন স্নাইপার। ইজরায়েলি স্নাইপারের গুলিতে খুন হন বেশ কিছু প্যালেস্তিনিয় সাংবাদিক, যারা পরিষ্কার “press” লেখা জ্যাকেট পরে সীমান্ত অঞ্চলে সাংবাদিকতা করছিলেন। গুলি করা হয় ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর, কারণ তাঁরা আহতদের চিকিৎসা করছিলেন।
উল্টোদিকে কেবলমাত্র ১ জন ইজরায়েলি সৈন্যের হাল্কা আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

গাজা-ইজরায়েল সীমান্তে ইজরায়েলি সেনার গুলিতে আহত সহ-আন্দোলনকারী। ছবিঃ মাহমুদ হামস/এ.এফ.পি/গেটি ইমেজেস।

সূত্রঃ ইন্টারনেট।
তবে এই প্রথম নয়। প্রায় দৈনন্দিন নিয়মমাফিক আক্রমণ বাদ দিলে, এর আগের বড় ইজরায়েলি হামলা হয় ২০১৪ সালে জুলাই–অগাস্ট মাস জুড়ে “অপারেশান প্রোটেক্টিভ এজ“ নামে। ৫১ দিন ধরে প্যালেস্তাইনের সাধারণ মানুষের উপর ইজরায়েলি গুলি ও বোমা বর্ষণ চলে, যাতে কিছু সূত্র অনুযায়ী মারা যান ২১৩১ প্যালেস্তিনিয়, যার মধ্যে অন্তত ১৪৭৩ জন সাধারণ নাগরিক, ৫০১টি শিশু, ও ২৫৭ জন মহিলা। অন্যদিকে ইজরায়েলি তরফে হতাহতের সংখ্যা: ৬৬ জন ইজরায়েলি সৈন্য এবং ৫জন সাধারণ নাগরিক। এর আগে ২০১২ সালের গ্রীষ্মকালে ৫০ দিন ব্যাপী ইজরায়েলি বোমাবাজিতে নিহত হন প্রায় ২২০০ প্যালেস্তিনিয়, যাঁদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। এর আগে ২০১২ সালে গাজা ভূখণ্ডের উপর এক সপ্তাহ ব্যাপী বোমাবর্ষণ চলে, ২০০৮–২০০৯ সালে চালানো হয় “অপারেশন কাস্ট লেড“, যাতে নিহত হন ১৪০০ মানুষ, যার অর্ধেকের বেশি সাধারণ নাগরিক, যার সম্বন্ধে ইউনাইটেড নেশনস–এর মানবাধিকার রিপোর্ট–এ বলা হয়, “সাধারণ মানুষকে আতংকিত ও পর্যুদস্ত করা এবং শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে একটি পরিকল্পিত অসমঞ্জস আক্রমণ“। অপারেশান কাস্ট লেড–এর প্রথম দিন প্রথম ৫ মিনিট–এর মধ্যে ৩০০ জন প্যালেস্তিনিয় সাধারণ নাগরিক খুন হন বলে খবর পাওয়া যায়। এর–ও আগে ২০০৬ সালে ইজরায়েল লেবানন–এর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানায়, যাতে মারা যান ৯০০ নাগরিক। এছাড়াও ইতিহাস–এ চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাই অসংখ্য যুদ্ধ। ১৯৪৮ সালে শুরু, যখন বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ব্রিটিশ রাজ প্যালেস্তাইন থেকে শেষমেশ নিজেদের শাসন প্রত্যাহার করছে, কিন্তু জন্ম দিয়ে যাচ্ছে এক অন্তহীন সংঘাতের। এই সময়ে ইজরায়েল গঠন করা হয়, ইজিপ্ট, লেবানন, জর্ডান, সিরিয়ার মতো আশেপাশের সমস্ত আরব দেশের সঙ্গে যুদ্ধের মাধ্যমে। ১৪ মে ১৯৪৮ জন্ম নেয় ইজরায়েলি রাষ্ট্র। এরপর থেকে ঘটে চলে অসংখ্য ছোট–বড় লাগাতার যুদ্ধ, যা এখনও চলেছে। তবে আরব রাজনীতির ফাটল ধরার পর, ও সোভিয়েত ইউনিয়ন–এর পতনের পর থেকে এই “যুদ্ধ” মূলত ইজরায়েলি একতরফা আক্রমণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৬৭ সালে তথাকথিত “৬ দিনের যুদ্ধে” ইজরায়েল ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, পূর্ব জেরুসালেম এবং গাজা দখল করে, সেই থেকে প্যালেস্তাইন–এর মানুষ সম্পূর্ণরূপে ইজরায়েলি রাষ্ট্রের হাতে বন্দি হয়ে পড়েন।

২০১৪-এ বেইত হানুন-এর ধ্বংসাবশেষ। ছবিঃ মহম্মদ আবেদ/ এ.এফ.পি./গেটি ইমেজেস।
জাতিসঙ্ঘে আমেরিকান (ভারতীয় বংশোদ্ভূত) রাষ্ট্রদূত নিক্কি হেলি আরও একবার ইজরায়েলি হামলার ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের প্রস্তাব ব্লক করেন। প্যালেস্তিনিয় রাজনৈতিক সংগঠন ‘হামাস‘কে এই ঘটনার জন্য দায়ী করার পর তিনি ইজরায়েলের ভূয়সী প্রশংসা করেন “সংযম” দেখানোর জন্য। তাঁর মতে, পৃথিবীর আর কোন রাষ্ট্র “তার নিজের সীমান্তে” এই ধরনের (তথাকথিত পালেস্তিনিয় “গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন“-এর মতন) কার্যকলাপ মেনে নেবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এই “সীমান্ত” ঠিক কোথায়, এর ইতিহাস কি, এবং “গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন“-ই বা কি, ও কেন। ইজরায়েল–এর এই সাম্প্রতিকতম আক্রমণ, এবং তার পাশাপাশি আমেরিকা–র রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প–এর মার্কিন দূতাবাস ইজরায়েল–এর রাজধানী তেল অভিভ থেকে সরিয়ে জেরুসালেম–এ স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্তকে বুঝতে হলে বুঝতে হবে “গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন“-কে, এবং সেই রাজনৈতিক ইতিহাসকে, যাকে সাধারণভাবে বলা হয় প্যালেস্টাইনের “ইজরায়েলিকরণ“। এই “ইজরায়েলিকরণ“-এর পাঁচটি মূল স্তম্ভ: জমি দখলের রাজনীতি, যুদ্ধ এবং যুদ্ধের কারখানা, অর্থনৈতিক আক্রমণ, সাংস্কৃতিক ও সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, এবং ত্রাণ তথা আন্তর্জাতিক সংহতির আর্থরাজনীতি। এই ধারাবাহিক লেখার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের এই নিষ্ঠুর ইতিহাস ও বর্তমান, এবং তার কয়েকটা দিক নিয়ে আলোচনা করা–ই মূল উদ্দেশ্য।
জমি দখলের রাজনীতি
১৯৪৮–এ ইজিপ্ট–ইজরায়েল যুদ্ধের ফলে পূর্ব জেরুসালেম–এ ইজরায়েল–এর অধিকার কায়েম হওয়ার পর থেকেই এই “ইজরায়েলিকরণের” সূত্রপাত। ৪৮–এর পার্টিশনের পর অধিগৃহীত অঞ্চলে নিজেদের দখল পাকা করতে ইজরায়েল সরকার শুরু করে “সেটলার মুভমেন্ট” – মানে এই সমস্ত অঞ্চলে সামরিক উপায়ে ঔপনিবেশিক কলোনী তৈরী করা, এবং “জায়োনিস্ট“, অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক ইহুদি পরিবার এবং ধর্মনেতাদের সেখানে বসবাস করতে সাহায্য এবং অনুপ্রাণিত করা। অদ্ভুত এই যে, যদিও ৪৮–পরবর্তী আন্তর্জাতিক শান্তিচুক্তি অনুযায়ী প্যালেস্তিনিয় অঞ্চলে এই ধরণের ইজরায়েলি বসতি “বেআইনি“, তবুও প্রকৃত অর্থে জাতিসংঘের বিভিন্ন শক্তিশালী সদস্য – যেমন আমেরিকা ও ইউরোপ–এর বিভিন্ন দেশ–এর প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা এবং নীরব সমর্থনের সাহায্যে বিনা বাধায় চলতে থাকে এই ঔপনিবেশিক কার্যক্রম। সময়ের সাথে সাথে বাড়তে বাড়তে এক সময়ের এই আরব ভূখণ্ড এখন আক্ষরিক অর্থে ‘ইজরায়েলি‘ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে পূর্ব জেরুসালেম–এর মতো জায়গায় প্যালেস্তিনিয় আরবরা দ্বিতীয় সারির নাগরিক হিসেবে গণ্য হন, এবং গাজা বা ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক অঞ্চলের মানুষ তাও নন – তাঁরা প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রবিহীন, নাগরিকত্ববিহীন একটি জনগোষ্ঠী, যাঁদের দেশ ও সমাজ গত ৭০ বছর ধরে বিদেশী শক্তির কাছে পরাধীন। পূর্ব জেরুসালেম–এ যেমন পালেস্তিনীয় পরিবারদের হেনস্থা করার পন্থা হিসেবে যেসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আছে, তার কয়েকটি উদাহরণ হ’লঃ

পূর্ব জেরুসালেম শহরতলিতে হার হোমা ইজরায়েলি সেটলমেন্ট। ছবিঃ এ.এফ.পি./গেটি ইমেজেস।
১. প্যালেস্তিনিয় জমি ও ঘরবাড়ি অধিগ্রহণ করে নেওয়া, নতুন বিল্ডিং পার্মিট দিতে অস্বীকার করা, এবং সুপরিকল্পিত ভাবে একটি একটি করে পালেস্তিনীয় ঘর ভেঙে দেওয়া,
২. প্যালেস্তিনিয় পাড়াগুলিকে নিজস্ব উপায়ে বাড়তে না দেওয়া, এবং উল্টোদিকে ইজরায়েলি সেটেলমেন্টগুলিকে সমস্ত রকম আর্থিক ও সামরিক সুবিধা দিয়ে দিনকে দিন বৃহৎ থেকে বৃহত্তর করে তোলা,
৩. পূর্ব জেরুসালেম–এ বসবাসকারী প্যালেস্তিনিয়দের “রেসিডেন্স পার্মিট” ও অন্যান্য অধিকার কেড়ে নেওয়া,
৪. প্যালেস্তিনিয় সদ্যজাত শিশুদের পঞ্জীকরণ করতে না দেওয়া, পালেস্তিনীয় পরিবারদের একে অপরের সঙ্গে দেখা হতে না দেওয়া, এবং এই ধরণের আরও বিভিন্ন নিষ্ঠুর পদ্ধতি।
পূর্ব জেরুসালেম–এ প্যালেস্তিনিয়দের থেকে কেড়ে নেওয়া জমি ও সম্পত্তি দিয়ে দেওয়া হতে থাকে ইহুদিদের, যাঁদের মধ্যে অনেকেই মূলত প্রবাসী। ইহুদি ধর্মীয়-রাষ্ট্রীয় কল্পনার বহুদিনকার রাজনৈতিক স্বপ্ন – পৃথিবীর সমস্ত ইহুদীর জন্য একটি আলাদা ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল – সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে ৪৮র যুদ্ধজয়ের পরে এঁরা একে একে এসে বসবাস করতে শুরু করেন এইসব সেটেলমেন্ট–এ। ১৯৫০–এ পাশ হয় ইজরায়েলি “ল অফ রিটার্ন“, বা “প্রত্যাবর্তন অধিনিয়ম“, যার মাধ্যমে এই “ফিরে আসা” কে আইনি বৈধতা দেওয়া–ই শুধু নয়, বস্তুত দখল করা আরব এলাকাগুলিকে ইহুদিদের এলাকা হিসেবে রাতারাতি পাল্টে ফেলার আইনি কার্যক্রম শুরু হয়। এই “রিটার্ন” হয়ে ওঠে ইজরায়েলি রাষ্ট্র ও পরিচয়নির্মাণের প্রক্রিয়ার একটি কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদিদের নিয়ে এসে এই কলোনিগুলিতে অভিবাসিত করা, সেই জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা করে দেওয়া, সামরিক “সুরক্ষা” দেওয়া, এবং রাতারাতি এই সমস্ত বিদেশী নাগরিককে ইজরায়েলি নাগরিকত্ব দেওয়া – এসব সেই ১৯৫০ থেকে চলে আসছে, এবং এখন ২০১৮–এ পৌঁছে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে “স্বাভাবিক” ও দৈনন্দিন হয়ে পড়েছে, যদিও আন্তর্জাতিক আইন–এর দিক থেকে দেখতে গেলে এই ঔপনিবেশিক কলোনিগুলি এখনো বেআইনি।

সূত্রঃ ইন্টারনেট। এই ম্যাপগুলির যথার্থতা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য হল ইজরায়েল কর্তৃক প্যালেস্তিনিয় জমিদখল-এর সাধারণ প্রবণতা তুলে ধরা।

ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইভাঙ্কা ট্রাম্প, জ্যারেড কুশনার-এর ইজরায়েল সফর। সূত্রঃ ইন্টারনেট।
উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প–এর মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্প খ্রিষ্টধর্ম থেকে ইহুদি ধর্মে ধর্মান্তরিত হন জ্যারেড কুশনার নামক ইহুদি ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ের আগে। সেই সূত্রে ইভাঙ্কা ট্রাম্প–এর ইজরায়েলি নাগরিকত্ব এবং জেরুসালেম–এ বসবাসের অধিকার সুনিশ্চিত। ইভাঙ্কা ট্রাম্প কিন্তু আমেরিকান, ইজরায়েল–এর সঙ্গে তাঁর কোনো ঐতিহাসিক বা বিবাহপূর্ব পারিবারিক সম্পর্ক নেই। অথচ এই ক‘দিন ধরে প্রত্যেক দিন যে হাজারদশেক করে মানুষ গাজা–ইজরায়েল সীমান্তে অবস্থান বিক্ষোভ করছিলেন, জেরুসালেমে ফিরতে পারার দাবিতে, তাঁরা অনেকেই কিন্তু এমনকি জেরুসালেমে নিজে জন্মেছেন এমন লোক। এখানে এটাও বলে রাখা প্রয়োজন যে কিছুদিন আগে জ্যারেড কুশনার–এর ইজরায়েলি জমিদালালি সংক্রান্ত বিভিন্ন সন্দেহজনক লেনদেন খবরে প্রকাশ হয়, যার মধ্যে আছে ইজরায়েল–এর সবচেয়ে বড়ো বীমা কোম্পানি Menora Mivtachim-এর দেওয়া ৩০ মিলিয়ন ডলার–এর মতো বিশাল পরিমাণ অর্থ। সন্দেহজনক মূলত এই কারণে যে কুশনার শুধু ব্যবসায়ী নন, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট–এর জামাই, এবং সেইসঙ্গে মার্কিন সরকারের একজন পদাধিকারী – তাঁর দায়িত্বসুচির মধ্যে অন্যতম হলো মধ্যপ্রাচ্যে (middle-east)-এর “শান্তিপ্রক্রিয়া“।

গাজা শহরের ইয়ুসুফ আল্ক্রনেয গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন-এ যান, এবং একটি পা হারিয়ে ফেরেন। ছবিঃ খালেদ তাবাশা।
৭০ বছর ব্যাপী এই ইজরায়েলি হত্যাযন্ত্রের প্রতিবাদে এই বছর ৩০ মার্চ “ভূমি দিবস” উপলক্ষ করে “দ্য গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন“–এর ডাক দেয় গাজার প্যালেস্তিনিয় জনগণ। গাজা–ইজরায়েল বর্ডারে, ভূমি দিবস থেকে শুরু করে ১৪ মে “নাকবা দিবস” অবধি ৬ সপ্তাহের এই প্রতিরোধ কর্মসূচীর “হাতিয়ার” ছিল মূলত টুকটাক মলোটভ ককটেল, জ্বলন্ত টায়ার, ঘুড়িতে বেঁধে ছোট বোমা, বা পাথর ছোড়া। মূলত নিরস্ত্র এই প্রতিরোধের মূল দাবি ছিল জাতিসংঘের রিসোলিউশন ১৯৪ অনুযায়ী যেসব প্যালেস্তিনিয় রিফিউজি ৪৮–এর যুদ্ধের পর থেকে ঘরছাড়া হয়ে আছেন, যেসব অঞ্চল অধুনা ইজরায়েল–এর কব্জায়, সেই সমস্ত মানুষদের ইজরায়েলে ফিরে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও প্রতিবাদের মুখ্য কিছু বিষয় ছিল গাজা ভূখণ্ডের উপর চলতে থাকা ইজরায়েল–এর দীর্ঘকালীন আর্থিক অবরোধ এবং আমেরিকান দূতাবাসের জেরুসালেম–এ স্থানান্তরের ঘোষণা। ১৯৭৬–এর ৩০ মার্চ বেআইনি ভাবে প্যালেস্তিনিয় জমি অধিগ্রহনের প্রতিবাদে ইজরায়েলের কয়েকটি আরব এলাকায় প্রতিরোধ মিছিল বার হয়। ইজরায়েলি পুলিশ গুলি করে হত্যা করে ৬ জন নিরস্ত্র আরব নাগরিককে, আহত হন শতাধিক মানুষ। এই দিনটিকেই পালন করা হয় “ভূমি দিবস” হিসেবে। ১৫ মে প্যালেস্তিনিয় “নাকবা দিবস“। ১৯৪৮ সালের এই দিনটি দগদগে হয়ে আছে প্যালেস্তিনিয় আরব স্মৃতিতে, ইজরায়েলের রাষ্ট্রগঠনের আগে ও পরে প্রায় ৭ লক্ষ গৃহহীন পালেস্তিনিয়র রাতারাতি রিফিউজি হয়ে যাওয়ার প্রতীক হিসেবে। প্রতিবছর এইদিন প্যালেস্তিনিয়রা শোকপালন করেন ৪৮–এর যুদ্ধে উজাড় হয়ে যাওয়া শ‘য়ে শ‘য়ে প্যালেস্তিনিয় গ্রাম–নগর–এর কথা স্মরণ ক‘রে। বিগত ৭০ বছর ধরে এঁরা কেউ ফিরে যেতে পারেননি নিজেদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামে।

https://www.middleeastmonitor.com/specials/refugee_journey/nakba/
গাজার প্রায় ৭০% মানুষ প্যালেস্তিনিয় রিফিউজি। ৪৮–এর যুদ্ধের পর গৃহহীন করে গাজায় ঠেলে পাঠানো হয় এইসব মানুষদের। এঁদের নিজেদের প্যালেস্তিনিয় জমি, গ্রাম, শহর এখন সব সীমানার ওপারে, ইজরায়েল–এর দখলে। এঁদের নিজের ঘরবাড়ি এখন সবই ইহুদি “সেটলার“-দের বাসস্থান। ২০১১ সালে ইজরায়েলি সংসদ “নেসেট” আইন রুজু করে যে “নাকবা দিবস”, যা কিনা অন্যদিকে ইজরায়েলি স্বাধীনতা দিবস–ও আবার, সেইদিন কোনো (পড়ুন প্যালেস্তিনিয়) সংগঠন যদি “নাকবা”–র শোকপালন করে, তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। এই বছর, সেই “নাকবা”–র স্মৃতি আবার উস্কে দিয়ে ছয় সপ্তাহ গণহত্যা চালায় ইজরায়েলি রাষ্ট্রযন্ত্র, কার্যত নিরস্ত্র প্যালেস্তিনিয় আন্দোলনকারী সাধারণ মানুষের উপর। প্যালেস্তাইন–এর ইজরায়েলিকরণ–এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এই ঘরে ফেরার লড়াই। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক–এর প্যালেস্তিনিয় লেখক সুয়াদ আমিরি তাঁর দ্বিতীয় ইংরেজি বই “Nothing to Lose but Your Life” (2010)-এ যে “ঘরে ফেরার” প্রসঙ্গে বলছেন, “There is no other place on this planet where I feel so out of place, so out of space, so out of time, so out of history, so out of meaning, so out of logic, so out of my skin, and so outraged as when I am in my historic ‘homeland Palestine’” – এই গ্রহের আর কোথাও আমি এতো বাইরের, এতো ঘরহীন, সময়ের সাথে এতো সম্পর্কহীন, ইতিহাসের সাথে এতো সম্পর্কহীন, এতো মানে–বিহীন, এতো যুক্তি–বিহীন, নিজের সাথে এতটা বিচ্ছিন্ন, বা এতটা ক্রুদ্ধ বোধ করিনি, যেটা আমার ঐতিহাসিক জন্মভূমি প্যালেস্তাইন–এ বোধ করেছি।
২০১৮–র জানুয়ারী মাসে ইজরায়েলি সরকার “রেগুলারাইজেশন অধিনিয়ম” পাশ ক‘রে হাজার হাজার হেক্টেয়ার ব্যক্তিগত মালিকানাভুক্ত প্যালেস্তিনিয় জমির উপর দখল এবং আনুমানিক ৪৫০০ ইহুদি সেটলার বাড়িঘরকে আইনগত স্বীকৃতি দেয়। এছাড়া পূর্ব জেরুসালেম এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক–এ দশ হাজারেরও বেশী সংখ্যক নতুন সেটলমেন্ট কলোনি তৈরির জন্য টেন্ডার ঘোষণা করে।
“আতঙ্কবাদ“

সূত্রঃ ইন্টারনেট।
Euro-Mediterranean Human Rights Monitor এবং United Nations Relief and Works Agency for Palestine Refugee (UNRWA) –র জানুয়ারী রিপোর্ট অনুযায়ী, এই মুহূর্তে

ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক-এ ইজরায়েলি সেটলমেন্ট। সূত্রঃ ওয়াশিংটন পোস্ট।
১। গাজা ভূখণ্ডের ৯৭% জল পানের অযোগ্য
২। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের গুদামগুলিতে ৪৫% ওষুধ নেই, সঙ্গে নেই ২৮% প্রয়োজনীয় মেডিকেল সরঞ্জাম
৩। ৫০% প্যালেস্তিনিয় শিশুর আজ মনস্তাত্বিক কাউন্সেলিং প্রয়োজন
৪। ২০১৭–এ বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসার আবেদনগুলির মধ্যে মাত্র ৫৪% আবেদন গ্রাহ্য করেছে ইজরায়েল সরকার – ২০০৬–এর পর এটি সর্বনিম্ন হার
৫। গাজার অধিবাসীদের মধ্যে ৪৪% রোজগারহীন। যুবকদের মধ্যে এই সংখ্যা ৬২%, শারীরিকভাবে ভিন্নভাবে সক্ষমদের মধ্যে এই সংখ্যা ৯০%।
৬। ৬৫% পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিছে বাস করেন (মৎস্যজীবীদের মধ্যে এই সংখ্যা ৯৫%), এবং ৭২%-এরও বেশী পরিবার পর্যাপ্তপরিমাণ খাওয়ার পান না।
৭। গাজার ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১৩ লক্ষ রিফিউজি – যাঁদের আসল ঘরবাড়ি ইজরায়েলের কব্জায়।
বন্দুকের নলের জোরে “সেটেলমেন্ট” বা জমি দখলের রাজনীতি, এবং তার ফলস্বরূপ উপরের লিস্টে উল্লিখিত পরিস্থিতি, এবং এইসব থেকে পরাধীন মানুষের মনে জমে ওঠা শতাব্দিব্যাপী ক্রোধ, স্বভাবতই জন্ম দেয় খুচরো পাল্টা আঘাতের। হামাস এবং অন্যান্য প্যালেস্তিনিয় জনসংগঠন কখনো কখনো ইজরায়েল কে লক্ষ্য ক‘রে উৎক্ষেপণ করে “রকেট“, যা ইজরায়েলি নিরাপত্তাব্যবস্থার কাছে নেহাত–ই “উন্নত আতসবাজি” ছাড়া খুব একটা কিছু নয়। এছাড়া শুনতে পাওয়া যায় “সেটলার“-দের কারও কারও উপর কখনো অতর্কিত ছুরিকাঘাত জাতীয় ঘটনা। জন্ম নেয় তথাকথিত “আতঙ্কবাদ“-এর জুজু। অথচ এ পর্যন্ত বিভিন্ন ইজরায়েলি আক্রমণে প্যালেস্তিনিয় ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান–এর তুলনায় প্যালেস্তিনিয় “আতঙ্কবাদী হামলায়” ইজরায়েলি হতাহতের সংখ্যা প্রায় নগণ্য।

গাজার উপর ইজরায়েলের হোয়াইট ফসফরাস বোমা। সূত্রঃ ইন্টারনেট।
২০১৭ সালে ২রা জুলাই খালিদা জার্রার নামের প্যালেস্তিনিয় বামপন্থী–নারীবাদী নেত্রী তথা সাংসদ এবং প্যালেস্তিনিয় রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার একজন রাজনৈতিক কর্মীকে, অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক–এর শহর রামাল্লায় তাঁর নিজের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ইজরায়েলি সেনা। সরকারি ভাষায় জার্রারকে “প্রশাসনিক হেফাজতে” রাখা হয়েছে, যার প্রকৃত অর্থ হল বিনা প্রমাণে এবং বিনা চার্জশীট–এ আটক করে রাখা। ইজরায়েলি সংবাদপত্র “হারীতজ” কে দেওয়া মন্তব্যে ইসরায়েল সরকারের প্রবক্তা বলেন, “PFLP –র মাধ্যমে আতঙ্কবাদী কাজকর্মে যুক্ত থাকার কারনে জার্রারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর সাথে তাঁর প্যালেস্তিনিয় বিধায়ক হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই“। PFLP অর্থাৎ Popular Front for the Liberation of Palestine, একটি বামপন্থী দল, যারা Palestinian Liberation Organization (PLO)-র সদস্য সংগঠন।

খালিদা জার্রার। সূত্রঃ ইন্টারনেট।
PFLP-র মুখপাত্র হাসান ব্রিজিএহ–র বক্তব্য অনুযায়ী, “ইজরায়েল মিথ্যে কথা বলছে। খালেদা–র PFLP সদস্যপদ এবং প্যালেস্তিনিয় বিধানসভায় তাঁর নির্বাচিত হওয়া ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।“ স্বাভাবিকভাবেই মুখ্যধারার সংবাদমাধ্যমে হাসান–এর বক্তব্য গুরুত্বহীন, অথচ ইজরায়েলি বক্তব্য খাঁটি, যার সত্যতাকে প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই। জার্রার–এর সম্পূর্ণ বেআইনি গ্রেফতার, পৃথিবীর সামনে তাকে একজন আতঙ্কবাদী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা, এবং সেই অজুহাতে বিনা বিচারে বিনা প্রমাণে তাঁকে আটক করে রাখা, তিনি একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও নেত্রী হওয়া সত্বেও – এসবই দৈনন্দিন স্বাভাবিক ঘটনা, আর এমনটা চলে আসছে সেই শুরুর থেকেই। তবে সেপ্টেম্বর ২০১১–এ নিউ ইয়রক–এর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নামক বহুতলে উগ্রপন্থী হানার পরবর্তী সময়ে প্যালেস্তিনিয় আরবদের “আতঙ্কবাদী” বলে ইজরায়েলি প্রচার নতুন মাত্রা পায়। খানিকটা ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে গোটা প্যালেস্তিনিয় প্রতিরোধকে এক কথায় “আতঙ্কবাদ” বলে চালিয়ে দেওয়ার মুলে রয়েছে “হামাস এবং PFLP –র মত সংগঠন আদতে আতঙ্কবাদী গোষ্ঠী” – এই সফল প্রচার। এই প্রচারের সাফল্যের মুলে আমেরিকা–ইউরোপের মতো “প্রথম বিশ্বের” দেশগুলির যা প্রায় জাতীয় চরিত্র – পৃথিবীতে কিছু মানুষের জীবন সম্পূর্ণ মূল্যহীন, আবার অন্য কিছু মানুষের জীবন সোনার থেকেও বেশি দামী। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, সুদূর ১৯৮৫ সালে এক–ই সপ্তাহে দুটি উগ্রপন্থী হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে একটি ঘটনায় মৃত ব্যক্তি ছিলেন লিওন ক্লিংহফার নামের এক আমেরিকান ইহুদি (Achille Laura নামক বিলাসতরীতে ৪ জন প্যালেস্তিনিয় হাইজ্যাকার যাকে খুন করেছিল), এবং অন্য ঘটনায় মৃত্যু হয় অ্যালেক্স ওদেহ নামের একজন আমেরিকান আরব–এর (দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর অফিসে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাঁকে খুন করে Jewish Defence League নামের ইহুদি সংগঠন)। আমেরিকান সংবাদমাধ্যম ক্লিংহফার–এর মৃত্যুকে নিয়ে আলোড়ন তৈরি করলেও ওদেহ–এর মৃত্যু নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায়নি। ২০১৪ সালে গাজায় নিরন্তর ইজরায়েলি আক্রমণ চালিয়ে যখন নিশ্চিনহ করে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক প্যালেস্তিনিয় পরিবার, তখন, অদ্ভুতভাবে, “Humanize Palestine” নামের ওয়েবসাইট চালাবার দরকার হয়ে পরছে। সেখানে পৃথিবীর মানবতার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য ছাপতে হচ্ছে, “ইমান খালীল আবেদ আম্মার–এর বয়স ছিল মাত্র 9 বছর। ২০ জুলাই শুজাইয়া গণহত্যায় খুন হয় ইমান, ও তার দুই ভাই – ৪ বছর বয়সী আসেম এবং ১৩ বছর বয়সী ইব্রাহিম।” প্রশ্ন হল, কেন প্রয়োজন পড়লো এই ধরনের ওয়েবসাইট–এর?

গাজায় ইজরায়েলি বোমাবর্ষণ। ২০১৪। সূত্রঃ ইন্টারনেট।
প্যালেস্তিনিয় আরবদের মনুষ্যেতর হিসেবে প্রচার করা, এবং তাদের মনুষ্যত্বকে বাইরের লোকচক্ষু থেকে আড়াল করে রাখার মাধ্যমে “প্যালেস্তিনিয় আন্দোলন একটি আতঙ্কবাদী আন্দোলন” – এই প্রচার সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে এসেছে ইজরায়েল–আমেরিকা যৌথশক্তি। এদের মতে, প্যালেস্তিনিয় প্রতিরোধের কোন বৃহত্তর উদ্দেশ্য বা রাজনৈতিক আদর্শ নেই। একমাত্র উদ্দেশ্য হল ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতি হিংসাবৃত্তি, যা কেবলমাত্র আরবদের “বর্বর প্রকৃতি“র ফসল। আরবরা যেহেতু ঠিক মানুষ নয়, কাজেই তাদের ক্ষেত্রে মৌলিক মানবাধিকার–ও প্রযোজ্য নয় – এই মত ইজরায়েল ও আমেরিকা, উভয় রাষ্ট্রই পোষণ করে। অথচ একইসঙ্গে অন্যদিকে ইজরায়েল–এর সর্বাঙ্গীণ অধিকার আছে একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে অধিষ্ঠান করার। পাশাপাশি অধিকার আছে খোলাখুলি প্যালেস্তাইনের উপর হামলা চালিয়ে যাওয়ার – গর্বভরে এবং চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে। এই অধিকার তারা বিগত ৭০ বছর ধরে ভোগ করে আসছে, গোটা “উন্নত বিশ্বের” সম্পূর্ণ সহযোগিতার সাহায্যে। জর্জ লোপেজ এবং মাইকেল স্তোল–এর মতে “রাজনৈতিক আতঙ্কবাদ“-এর সংজ্ঞা হল : “আক্রান্ত ব্যক্তি অথবা/এবং প্রত্যক্ষদর্শীর মনে আতঙ্ক তৈরি অথবা আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য সুপরিকল্পিত আতঙ্কমূলক ক্রিয়াকলাপ বা তেমন কিছুর হুমকি দেওয়া“। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী নিঃসন্দেহে ইজরায়েল–এর ১৯৪৮–এর প্যালেস্তাইন আক্রমণ ও তারপর যুদ্ধজয়ের ফলে অধিকৃত পালেস্তিনিয় ভূখণ্ডে গায়ের জোরে নিজের শাসন কায়েম করা, ১৯ বছর বাদে ১৯৬৭–র আক্রমণের পরে বাকি প্যালেস্তাইন এবং পূর্ব জেরুসালেম দখল করা, এবং তারপর থেকে আজ অবধি সমস্ত প্যালেস্তিনিয় মানুষকে পাশবিক হিংসার মাধ্যমে গাজা–ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক–জেরুসালেম নামের “উন্মুক্ত কারাগারে” বন্দি করে রাখা – এসব চূড়ান্ত আতঙ্কবাদের উদাহরণ না হয়ে যায়না।

প্নেই কেদেম ইহুদি সেটলমেন্ট-এ অস্ত্রপ্রশিক্ষন্রত মহিলারা। সূত্রঃ ইন্টারনেট।
PFLP-র সেই মুখপাত্র হাসান ব্রিজিএহ–র ভাই ইমাদ ইসরায়েলি সেনার বুলেটে শহীদ হয়েছিলেন। হাসান এবং ইমাদ–এর মা ফাতেমে ব্রিজিএহ বেথলেহেম–এর আল–মাসারা গ্রামের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাঁর নিজের কথায়, “আমি শেষ নিঃশ্বাস অবধি লড়তে প্রস্তুত। শুধু তাই নয়, অন্য সকলকে লড়তে উদ্বুদ্ধ করতে চাই, আমার সন্তানদের লড়তে শেখাতে চাই, ওদের দুধে প্রতিরোধ মিশিয়ে দিতে চাই। প্রতিরোধ। প্রতিরোধ ছাড়া আর কিচ্ছু নেই আমাদের জীবনে। যখন সম্ভব শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ। অন্ততপক্ষে শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ আমাদের করতেই হবে। আমাদের বাস্তব আমাদের–ই তুলে ধরতে হবে পৃথিবীর কাছে। তথাকথিত “সভ্য জগত“-এর মানুষ নিজেদের ছোটখাটো আঘাত নিয়েও বিচলিত হয়ে থাকে। কারুর পায়ে কাঁটা ফুটলেও সেখানে মানবাধিকারের প্রশ্ন তোলা হয়। জাতিসঙ্ঘ আস্ফালন ক‘রে বলে, মানবাধিকার আছে রক্ষা করার জন্যে। কিন্তু যখন পালেস্তাইনের মানুষের প্রশ্ন ওঠে, তখন না আছে মানবাধিকার, না আছে জাতিসঙ্ঘ। সেই ১৯৪৮ থেকে আমরা জাতিসঙ্ঘের রেজোলিউশান শুনে আসছি। আজ আমরা সেইসব রেজোলিউশানের বাস্তবায়ন চাই, এই দাবিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাই। এবং এই শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের মাধ্যমে আমরা দখলকারী সেনাবাহিনী এবং ওদের পক্ষকে দুনিয়ার সামনে বেনকাব করতে চাই। আজ ইউরোপ–এ কিছু মানুষ শেষ পর্যন্ত বুঝতে শুরু করেছেন, যে পালেস্তিনিয় বলে কিছু একটা হয়, যে প্যালেস্তিনিয়রাও মানুষ। অথচ এই যে লোকটা এইবার আমেরিকার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে [Donald Trump], এ বলে “প্যালেস্তিনিয়” ব্যাপারটা একটা রটনামাত্র। আমরা একটা গোটা সামাজব্যবস্থা। আমরা এখানকার বাসিন্দা। ওরা বলে ওরা ৩০০০ বছর ধরে এখানে বাস করছে, জেকব–এর সময় থেকে। অথচ আমরা এখানে ৭০০০ বছর থেকে রয়েছি, এখানেই আমাদের শেকড়। আমরা এই মাটির সন্তান। এখানকার মাটির রঙ লক্ষ্য কর, আর আমাদের চামড়ার রঙ দেখো; দেখবে এখানকার মাটি আমাদেরই গায়ের রঙের। এখানকার একেকটা ঘাস আমরা চিনি। ওরা তো চেনে না। ওরা জানে শুধু অস্ত্র ধরতে আর লুঠ করতে। ওরা আমাদের জল লুঠ করেছে। ওরা আমাদের পূর্বপুরুষদের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রাখা আশীর্বাদ লুঠ করেছে।“
৩১শে মে–র খবর, আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নিক্কি হেলি “গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক–এর মানুষদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা হোক” – জাতিসঙ্ঘের এমনই একটি অরাজনৈতিক রেজোলিউশানকেও আটকে দিয়েছেন (‘ভিটো‘ করেছেন)। এক–ই সঙ্গে আমেরিকা জাতিসঙ্ঘে রেজোলিউশান প্রস্তাব করেছে যে এই সাম্প্রতিকতম পর্যায়ে প্যালেস্তিনিয় মানুষের প্রাণহানির জন্য হামাস কে দায়ী করা হোক। এদিকে গাজা বর্ডারে ইজরায়েলি গুলিবৃষ্টি লাগাতার চলছে। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী এ পর্যন্ত খুন হয়েছেন ১২১ জন প্যালেস্তিনিয়, ১৩০০০–এর উপর গুরুতরভাবে আহত। ১লা জুন খুন হন ২১ বছর বয়সী রাজান–আল নাজার নামের মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী। নার্স–এর সাদা পোশাক প‘রে আহতদের চিকিৎসারত অবস্থায় তাঁকে বুকে গুলি করে খুন করে ইজরায়েলি স্নাইপার। বিশ্বব্যাপী হাহাকারের মধ্যে রাজান–এর শেষকৃত্যে যোগ দেন হাজার হাজার সাধারণ প্যালেস্তিনিয় মানুষ। কিছুদিন বাদে খুন করা হয় রাজান–এর ভাইকে।

গাজা-ইজরায়েল সীমান্তে কর্মরত রাজান-আল নাজার। ম্রিত্যুর পূর্বে। সূত্রঃ ইন্টারনেট।
লেখক একজন স্বতন্ত্র সাংবাদিক।
ইহুদীদের হোলি বুক তালমুদেই সরাসরিভাবে বলা আছে যে নন-জিউ বা অইহুদীরা সকলেই হল goy অর্থাৎ জানোয়ারতুল্য, এবং উহাদেরকে শোষণ বা হত্যাকরাটা কোনটিই অপরাধ নয়!