সিদ্ধার্থ বসু
চলেছি একইভাবে। লজ্জা নেই, ঘেন্না নেই কোনো। খাফিল খানের গোরখপুরকে পিছনে ফেলে এসেছি, অনায়াসে। শিশুমৃত্যু আটকাতে গিয়ে তাঁর চাকরি গেছিল। যোগী আদিত্যনাথের ভোটকেন্দ্রে। আসানসোলের পুত্রহারা ইমদাদুল রশিদির, দাঙ্গা- আটকাতে পুত্রশোককে-উৎসর্গ-করাকেও আমরা সন্দেহ করতে ছাড়িনি। এবার উত্তরাখণ্ড। হিন্দু বান্ধবীর হাত ধরে ‘পবিত্র’ মন্দিরে ঢুকেছিলেন এক মুসলমান যুবক। জনগণ–দেশপ্রেমিক জনগণ, সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীতে উঠে দাঁড়ানো জনগণ, গোমাতার মাংসের সম্মানে মানুষের গলা নামিয়ে নেওয়া জনগণ–সম্ভাব্য লাভ জিহাদের অনাচার ঠেকাতে রণোন্মত্ত হয়ে ওঠে। সেই জনরোষকে বাঁধ দিতে এগিয়ে আসেন মাত্র সাত মাস চাকরিতে ঢোকা এক শিখ পুলিশ ইন্সপেক্টর, গগনদীপ সিং। নিজেও প্রভূত চোট-আঘাত শরীরে নিয়ে তিনি ছেলেটিকে উদ্ধার করেন। একজন মানুষের কাজ তো বটেই, অধিকন্তু গগন নিখুঁত পালন করেন এক পুলিশকর্মীর কর্তব্য, আইন অটুট রাখার দায়িত্ব। ঘটনার পরে একটি সংবাদসংস্থায় তাঁর মুখ থেকে শুনতে পাওয়া যায় যে পুলিশের পোষাক গায়ে না থাকলেও তিনি এ কাজ করতেন, তাঁর মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে। ছেলেমেয়েদুটি অক্ষত দেহে ফিরে যায়।
ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় চাউর হতেই–এই ক্লিন্ন ঘৃণার বাতাবরণ তুচ্ছ করে–আম পাব্লিকের চোখে নায়কের মর্যাদা পেতে শুরু করেন ওই ইন্সপেক্টর। এঁরাও কিন্তু জনগণ সব। রামনগরের গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশ থেকেই আসতে থাকে শুভেচ্ছাবার্তা। সেলিব্রিটিরাও কেউ কেউ– চেতন ভগত, তসলিমা নাস্রিন–অভিনন্দন জানান এই মানবিক আইনরক্ষককে।
Gagandeep Singh, Courageous Brave, Sikh Police Officer saved a Muslim man who came to meet his Hindu Girlfriend, from being Lynched by Hindutva Mob in Uttarakhand. #ISalute #SinghIsKing pic.twitter.com/oXGgGHCUfv
— Aarti (@aartic02) May 24, 2018
ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটে সমাজের ত্রাতাদের। বিজেপির স্থানীয় নেতারা–এমেলএ রাজকুমার ঠুকরাল, স্থানীয় নেতা রাকেশ নৈনওয়াল প্রমুখ–প্রচণ্ড বিক্ষোভ প্রকাশ করেন হিন্দু পবিত্রতার পরাকাষ্ঠার ভিতরে বিধর্মীর প্রবেশের এই চরম অন্যায্যতায়। এর মধ্যে যে ধর্মীয় অভিসন্ধি আছে সে বিষয়ে তাঁদের নিঃসংশয় দেখা যায়: হিন্দুরাও মসজিদে যায় না, অতএব ‘ওরা’ও আসবে না মন্দিরে। তার মানে দাঁড়ায়, দোষ ওই যুগলের, আরো নির্দিষ্ট করে ওই মুসলিম যুবকের। এবং এ অপরাধের যথার্থ বিধান ওই ধার্য গণপিটুনির মধ্যেই নিহিত ছিল। সে ন্যায্যতার বিরোধ করে হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রতি অবিচার করেছেন গগনদীপ।
#WATCH "We don't go to mosques or madrasas because we don't have the right to go. Why did they go to temple with an intention to destroy Hindu Sabhyata?," says BJP MLA Rajkumar Thukral on Sub Inspector Gagandeep Singh rescuing a Muslim man from a mob in #Uttarakhand’s Ramnagar pic.twitter.com/5rTLwBUs3X
— ANI (@ANI) May 28, 2018
এ-ই তবে আইনের শাসন, হিন্দুত্বের ধারকদের হাতে। ঠিক যেমন তালিবানি শুভবুদ্ধির দাপটে খোলা রাস্তায় বেত খেতে হয়েছিল আফগান মহিলাদের, চোখ দেখা যাওয়ার অপরাধে। পুলিশের ওপরয়ালারাও–পুরস্কার বা অভিনন্দন নয়– গগন্দীপকে কাউন্সেলিং নিতে পাঠাতে চান আগে, তারপর অন্য কথা। সে কেমন কাউন্সেলিং? কাকে কেন দেওয়া হবে সেসব? এসব প্রশ্নে নীরব তাঁরা। অর্থাৎ অভিযোগের তির গগনেরই দিকে। আপাতত তাঁকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তাঁকে উদ্দেশ্য করে ছুটে আসছে তীব্র হিংসা, যার বাহারি নাম ‘হেট স্পিচ’। এ ধরনের দুর্মতি কারো কারো আগেও যে হত না এমন নয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান– রাষ্ট্র ও তার আইন– স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এগিয়ে এসে মান্যতা দিত না তাদের এরকম ছুটকো হিংসাত্মক প্রবণতাকে। ফলে তারা দ্রুতই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। কিন্তু আজকের বাস্তবতা?
কিন্তু, রামনগর জেলার অধিবাসীদের কাছে গগনদীপ এখনো নায়ক। তাঁদের মতে ছেলেমেয়েরা স্ব-ইচ্ছায় যেতে পারে যেকোনো জায়গাতেই, তাতে লাভ জিহাদের লালচোখ দেখা অহৈতুকি। এঁরাও জনতা। মানুষ শান্তিতে ঘুমোতে যেতে চায়, তারপর ধাক্কাধাক্কি করে দোকান-বাজার-অফিস-কাছারি করতে চায় ঘামে-নুনে এক হয়ে, ফিরতি পথে চা-এর ঠেকে তাল ঠুকে খিস্তি করতেও তাদের বাঁধে না–কিন্তু তারা রক্ত চায় না, খুনোখুনি চায় না, আতঙ্কের হাতে সঁপে দিতে চায় না এই মহার্ঘ্য আয়ু। কায়্রানা উপনির্বাচনের ফল বেরিয়েছে — সাম্প্রতিক জাট-মুস্লিম দাঙ্গার কায়্রানা — বিজেপি পরাজিত। তার সাথে হার হয়েছে আরও কিছু কেন্দ্রে। এই ভোটারেরাও জনতা। “ভরসা যেন না পায় যত, দাঙ্গামুখো হতচ্ছাড়া/ সবাই মিলে বেঁচে থাকা ভরসা তাদের করুক তাড়া”।
সিদ্ধার্থ বসু শিক্ষক এবং লেখক।