মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার আর চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মীর কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা


  • May 20, 2018
  • (0 Comments)
  • 3900 Views

স্বাস্থ্যখাতে সরকারী খরচ কমছে। সরকারের লক্ষ্য জনগণের করের টাকায় বেসরকারী বীমা কোম্পানী ও বেসরকারী হাসপাতালের স্বাস্থ্যবৃদ্ধি। পাশাপাশি চলছে বিনামূল্যে চিকিৎসার নামে প্রহসন। অথচ রোগীদের অসহায় রোষ এসে পড়ছে ডাক্তারদের উপর। প্রতিবাদে এবার পথে নামছেন ডাক্তাররা, নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন। তাঁরা বুঝছেন মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার না থাকলে তাঁদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা মিলতে পারে না।

ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ

২০১৮-র ১১ই মে মেডিকাল কলেজ থেকে বৌবাজার-সেন্ট্রাল এভিনিউর ক্রসিং অবধি পথ চলল পাঁচশ মানুষের এক মিছিল। বিকাল ৬টায় মিছিল শুরুর আগেই আকাশ কালো করে ঝড় উঠেছিল, বৃষ্টি পড়ছিল। কিন্তু এসোশিয়েসন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস, ডক্টরস ফর ডেমোক্রাসি, ডক্টরস ফর পেশেন্টস, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডেন্টাল সার্ভিস এসোশিয়েসন এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের ডাকে সরকারী-বেসরকারী ডাক্তার ও তাঁদের পরিবারের মানুষদের লক্ষ্য থেকে টলাতে পারেনি প্রকৃতির ভ্রূকুটি। মুখে কালো কাপড় বেঁধে, হাতে মোমবাতি নিয়ে তাঁরা লালবাজার চলেছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে ডেপুটেশন দিতে। ২রা এপ্রিল নবান্নে ডাক্তার সংগঠনগুলির বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী/স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন—ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে, আক্রমণকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। অথচ ২রা এপ্রিল থেকে ১০ই মে রাজ্যের নানা প্রান্তে ঘটেছে ১৪টি আক্রমণের ঘটনা। পুরুলিয়ার বড়াবাজারে আক্রমণকারীদের নেতা শাসকদলের পঞ্চায়েত নির্বাচন-প্রার্থী। পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই এই ডেপুটেশন। মিছিলকে আটকে দেওয়া হলো ১৪৪ধারার অজুহাতে, ডিজি বা কোন উচ্চপদস্থ অধিকারী কথা বলার সৌজন্যটুকুও দেখালেন না, ভবানী ভবনে মেমোরেন্ডাম রিসিভ করিয়ে আনা হলো। যাওয়ার পথে মিছিল ছিল নীরব, হাতে প্ল্যাকার্ড-ব্যানার—ডাক্তারদের ওপর আক্রমণ বন্ধ হোক, সরকারী হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নত করা হোক, সরকার নাগরিকের স্বাস্থ্যের অধিকারকে স্বীকার করে নিক। ফেরার পথে ক্ষুব্ধ মিছিল স্লোগান তুলল—স্বাস্থ্য কোনো ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য আমার অধিকার। 

নব্বই দশকের শুরু থেকে বিশ্বব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের নির্দেশ মেনে সরকার সরে আসতে লাগল স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে। ইউজার ফি নেওয়া শুরু হলো, সরকারী পরিকাঠামো যা এক সময় ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ তা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকল। সরকারের ছেড়ে আসা ফাঁকা জায়গার দখল নিতে থাকল স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা।

মনে পড়ছিল ৩৫ বছর আগেকার কথা। ১৯৮৩। সবে নতুন ইন্টার্ন হয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের সাতটি সরকারী মেডিকাল কলেজ তখন, সেগুলির জুনিয়ার ডাক্তারদের যুক্ত মঞ্চ অল বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তার ফেডারেশনের নেতৃত্বে আন্দোলন চলেছিল, বারবার কলকাতার রাজপথ কাঁপিয়ে আমরা এসপ্ল্যানেড ইস্টে গেছি। স্বাস্থ্য কোনো ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য আমার অধিকার—সেই আন্দোলনের স্লোগান।

না, ভারতের সংবিধানে স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয়। যদিও ১৯৪৮-এর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তবু ১৯৪৭-এর পরের সরকারগুলি কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা থেকে অনেকটা পরিমাণে জনসাধারণের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিতেন।

চিকিৎসা অর্থাৎ স্বাস্থ্য পরিষেবা বরাবরই একটা পণ্য ছিল। কিন্তু অন্য পণ্যের সঙ্গে চিকিৎসায় ব্যবহৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা ওষুধপত্রের ফারাক হল এই যে, এগুলির ক্ষেত্রে ক্রেতা এবং বিক্রেতার মাঝে থাকেন চিকিৎসক, যিনি ক্রেতার হয়ে এগুলি বাছাই করে দেন। অর্থাৎ রোগী কোন পরীক্ষা করাবেন, কোন ওষুধ খাবেন তা ঠিক করে দেন ডাক্তার। স্বভাবতই এক্ষেত্রে দুর্নীতির সুযোগ থাকে—ওষুধ কোম্পানী-ডায়াগনোস্টিক সেন্টার-রেফারেল থেকে কমিশন খাওয়ার সুযোগ থাকে দুর্নীতিপরায়ণ চিকিৎসকের। (ডাক্তাররা তো আকাশ থেকে পড়েন না, এই সমাজেই তাঁদের জন্ম, রাজনেতা-পুলিশ-জজ-উকিল-সরকারী অফিসার যে সমাজে দুর্নীতিগ্রস্ত, সেখানে ডাক্তারদের মধ্যেও কিছুজন দুর্নীতিপরায়ণ হবেন—এমনটা কাম্য না হলেও বাস্তব।) আগে চিকিৎসা পরিষেবায় সরকারী বিনামূল্যে চিকিৎসা-ব্যবস্থা প্রধান ছিল, তাই দুর্নীতির সুযোগ কম ছিল, ডাক্তার-রোগী সম্পর্কও বিষিয়ে যায়নি।

মিছিল আটকালো পুলিশ

১৯৮৬-তে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে নিয়ে আসা হল ক্রেতা-সুরক্ষা আইনের আওতায়। নব্বই দশকের শুরু থেকে বিশ্বব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের নির্দেশ মেনে সরকার সরে আসতে লাগল স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে। ইউজার ফি নেওয়া শুরু হলো, সরকারী পরিকাঠামো যা এক সময় ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ তা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকল। সরকারের ছেড়ে আসা ফাঁকা জায়গার দখল নিতে থাকল স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা। সরকারী পরিকাঠামো দিনের পর দিন দুর্বল হতে থাকায় মধ্যবিত্ত এমনকী নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিকেও ঘটিবাটি বিক্রি করে ভিড় জমাতে হচ্ছে বেসরকারী হাসপাতালে, মুনাফাই যাদের একমাত্র লক্ষ্য।

ডাক্তাররা আজ এক অদ্ভুত অবস্থায়। আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগেও এক সদ্য পাশ করা ডাক্তার একটি স্টেথোস্কোপ ও ব্লাড প্রেশার মাপার মেশিন সম্বল করে বাড়ির একটি ঘরে বা পাড়ার ওষুধের দোকানে প্র্যাকটিস শুরু করতে পারতেন। ডাক্তারের আয়ও হত, রোগীরাও কম খরচে পরিষেবা পেতেন। ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট-এর গেরোয় সদ্য পাশ করা ব্যক্তি-ডাক্তারের নিজের ব্যাবসা শুরু করা বড়ো মাপের পুঁজি বিনিয়োগের ব্যাপার। ১৯৭১-এ দেশের সংসদে ঠিকাদারি প্রথা উন্মূলনের লক্ষ্যে এক আইন পাশ হয়েছিল। শ্রমিকদের ঠিকাদারি প্রথা তো বিলুপ্ত হয়ইনি বরং ডাক্তারদের অধিকাংশ সরকারী চাকরি আজ কনট্র্যাক্টচুয়াল। সরকারী হাসপাতালে কাজ করলে চিকিৎসা না-পাওয়া-রোগী/পরিজনের শিকার হতে হচ্ছে তাকে আর বেসরকারী হাসপাতালে কাজ করলে ব্যাবসাদারের টার্গেট পূরণের যন্ত্র ডাক্তার। বেসরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের সামনেও সেই ডাক্তাররাই।

গত একবছরে সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে হিংসার ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। ডাক্তাররা সংঘবদ্ধ হয়েছেন। ডক্টরস ফর ডেমোক্রাসি, ডক্টরস ফর পেশেন্টস, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম এই পর্যায়ে গড়ে ওঠা। পুরোনো সংগঠনগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে এরা তৈরি করেছেন ডাক্তারদের যুক্ত মঞ্চ। পাশাপাশি এসেছে ডাক্তারদের মার্শাল আর্ট শেখার প্রস্তাব, অ্যাপ তৈরী হয়েছে যাতে এক ডাক্তার আক্রান্ত হলে অন্যরা ছুটে যেতে পারেন। কিন্তু এসবে কি আক্রমণ ঠেকানো যাবে?

ডাক্তারদের কি কিছু করার আছে?

যদি অবস্থাটা এমন হতো যে, অসুস্থ হলে নাগরিক কোথায় যাবেন তা ঠিক করা আছে। কোন রোগে কি ওষুধ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে তা নির্দিষ্ট আছে স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট গাইডলাইনে। কখন রোগীকে বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করা হবে বা ভর্তি করে চিকিৎসা করা হবে তাও নির্দিষ্ট করা আছে। কোথাও রোগীর কোনও খরচ হবে না, খরচ যোগাবে দেশের সরকার ট্যাক্স বাবদ সংগৃহীত অর্থ থেকে। অর্থাৎ ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর সম্পর্কে কোনও আর্থিক লেনদেন নেই। তাহলে রোগী-ডাক্তারের সম্পর্কে অবিশ্বাস-হিংসা থাকতো না।

এক স্বপ্নের ব্যবস্থার কথা বলে মনে হলেও এমন ব্যবস্থাই কিন্তু আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদে সমস্ত উন্নত দেশে, থাইল্যান্ডের মতো উন্নয়নশীল দেশে, শ্রীলংকার মতো গরীব দেশে।

ভারতের সরকার ১৯৭৮-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা আটা সম্মেলনে ‘২০০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য’-এর ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলেও সেই ব্যবস্থার দিকে এগোয়নি।

ভারতেও সম্ভব

প্রতিবাদের ভাষা

সেই সম্ভাবনার কথা বলেছে সরকারেরই একটি কমিটি—২০১০-এ যোজনা কমিশন গঠিত High Level Expert Group on Universal Health Coverage (HLEG), যার নেতৃত্বে ছিলেন ডা কে শ্রীনাথ রেড্ডি। HLEG ২০১১-এ তার সুপারিশ জমা দেয়। বলা হয়, ২০১০-এ স্বাস্থ্যখাতে সরকারী খরচ জিডিপি-র ১.৪% থেকে বাড়িয়ে ২০১৭-র মধ্যে ২.৫%, ২০২২-এর মধ্যে ৩% করা হলে সরকারী পরিকাঠামোকে উন্নত করে তার মধ্যে দিয়ে অত্যাবশ্যক প্রাইমারী, সেকেন্ডারী ও টার্সিয়ারী পরিষেবা বিনামূল্যে দেওয়া যায়। কোন অত্যাবশ্যক পরিষেবা যদি বেসরকারী হাসপাতাল থেকে কিনতেই হয় তাহলে রোগীর জন্য তা কিনবে একটি স্বশাসিত আধা-সরকারী কমিটি, রোগীর কোনও খরচ হবে না। সমস্ত নাগরিক তাদের প্রয়োজন মতো অত্যাবশ্যক ওষুধ পাবে বিনামূল্যে। প্রত্যেকের জন্য থাকবে হেলথ কার্ড, যা দেখিয়ে প্রয়োজনে অত্যাবশ্যক পরিষেবা পাওয়া যাবে বিনামূল্যে। স্বাস্থ্যবীমা ও ইউজার ফি-র কোনও স্থান থাকবে না সে ব্যবস্থায়।

২০১২-এ যোজনা কমিশন HLEG-র সুপারিশ মানে নি। ২০১৪-এ মোদী সরকার এসে স্বাস্থ্যখাতে সরকারী খরচ কমালো ২০%। ২০১৭-র জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি বলুন বা ২০১৮-র কেন্দ্রীয় বাজেট—সরকারের লক্ষ্য জনগণের করের টাকায় বেসরকারী বীমা কোম্পানী ও বেসরকারী হাসপাতালের স্বাস্থ্যবৃদ্ধি। সবচেয়ে বেশী চিকিৎসার খরচ হয় আউটডোর চিকিৎসা, ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। সরকার গরীব মানুষের জন্য প্রিমিয়াম দিয়ে যে বীমা করাবেন, তাতে এসবের খরচ পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে কেবল হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসার কিছু খরচ।

পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে যে চিকিৎসা পরিষেবা ঘোষণা করেছে, তাও তথৈবচ। পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতে মাসের পর মাস লাগছে, উপকরণের অভাবে রোগী অপেক্ষারত, প্রথমে যে ওষুধের তালিকা ঘোষণা করা হয়েছিল তার দুই-তৃতীয়াংশ ছাঁটাই হয়ে গেছে।

শ্রমজীবী স্বাস্থ্য আন্দোলন তার ১৯৯৯-এ তার জন্মলগ্ন থেকেই স্বাস্থ্যের অধিকার আন্দোলনে যুক্ত। ২০১৩ থেকে শ্রীনাথ রেড্ডি কমিটি-র সুপারিশ নিয়ে তারা প্রচার করে চলেছে সারা বাংলায়, ২০১৫-এ গঠিত হয়েছে সারা বাংলা সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রচার কমিটি, ২০১৭ থেকে তাদের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে জাতীয় স্তরেও। ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামও সবার জন্য স্বাস্থ্যকে তার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে, দাবী তুলছে শ্রীনাথ রেড্ডি কমিটির সুপারিশগুলিকে লাগু করার, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সব রকমের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলছে, বেসরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। ডাক্তাররা আজ বুঝছেন মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার না থাকলে তাঁদের কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা হতে পারে না। এগুলি অবশ্যই আশার কথা।

ছবি:  http://www.kaushikghosh.net/

লেখক জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।
Share this
Tags :
Leave a Comment