আমরা বাংলাদেশের ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা সংগ্রামের কথা জানি, যার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আজকে যখন সারা দেশ জুড়ে আধিপত্যবাদের রাজনীতি চরমে, যখন মানুষের বিভিন্ন অধিকারে নানা ভাবে হস্তক্ষেপ করার প্রবণতা বাড়ছে, বিশেষত অসমে বর্তমানে নাগরিক পঞ্জী নবায়নের নামে হাজার হাজার বাঙালিকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এরকম একটি সময়ে দাঁড়িয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি অসমে সংঘটিত ১৯ মে-র ভাষা আন্দোলনের কথাও চর্চায় উঠে আসা একান্ত জরুরি। লিখেছেন প্রজ্ঞা অন্বেষা।
সাল ১৯৬১। সেই বছরের মে মাসটি আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালিদের কাছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাস হিসেবে পরিচিত। এই সংগ্রাম ছিল মূলত অসম সরকারের চাপিয়ে দেওয়া ভাষা বিলের আগ্রাসনমূলক বিধির বিরুদ্ধে। যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯ মে আসামের কাছাড় জেলার শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ১১ জন বাংলা ভাষাভাষী মানুষ।
প্রথমে দেখে নেওয়া যাক কী ছিল এই ভাষা বিলে।
১৯৬০-এর ১৪ অক্টোবর তারিখে প্রস্তাবিত এই রাজ্যভাষা বিলে বলা হয়েছিল , রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়া গৃহীত হবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন ইংরেজির ব্যবহার চলছিল তেমনই চলবে যার স্থানে পরবর্তীতে হিন্দি ব্যবহৃত হবে। প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য শুধুমাত্র কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হবে। কিন্তু এই বিলের সঙ্গে একটি বিশেষ বিধি সংযোজন করে দেওয়া হয়েছিল। যে বিধিতে বলা হয়েছিল –
“The Bengali language shall be used for administrative and other official purposes upto and including the district level in the district of Cachar until the Mahkuma Parishads and Municipal Boards of the district in a joint meeting by a majority of not less than two-thirds of the members present and voting decide in favour of adoption of the official language for use in the district…”1
এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যেই অসমিয়া ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্তে চূড়ান্ত সিলমোহরটি বসানোর চেষ্টা হিসেবে বিধানসভায় আনা হল ভাষা বিলের প্রস্তাব। এই বিলের সাথে যুক্ত করে দেওয়া মহকুমা বিধিটি থেকে একথা স্পষ্ট যে আসলে বাংলা ভাষায় কাজকর্মের অধিকারকে কেড়ে নেওয়ার চক্রান্তেরই এটি ছিল একটি অংশ।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই বিধি শুধুমাত্র কাছাড় জেলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল অন্য কোনও জেলার ক্ষেত্রে নয়।এভাবে মহকুমা পরিষদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ভবিষ্যতে এই বিধিকে বাংলাভাষী প্রধান কাছাড় জেলায় অসমিয়া ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতে পারে বলে বাংলা ভাষাভাষীরা আশঙ্কা করেন। নানা পক্ষের বিরোধিতার মধ্যেই ২৩ অক্টোবর তারিখে এক তরফাভাবে কেবল মাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিরিখে বিলটি পাশ হয়ে যায়। যেখানে দীর্ঘদিন ধরে অন-অসমিয়াদের দাবি ছিল অসমিয়া, বাংলা ও ইংরেজি বা হিন্দি এই তিনটি ভাষাকে সরকারি ভাষা করার সেখানে এই বিলটি বাঙালিদের সঙ্গে সঙ্গে অসমে বসবাসকারী অন্যান্য অন-অসমিয়া উপজাতিদের মাতৃভাষা চর্চার অধিকারকেও কেড়ে নিতে চেয়েছিল।
এই সময়েই যে প্রথমবারের মত অসমে বসবাসকারী বাঙালিরা বা অন্যান্য অন-অসমিয়া জাতিরা ভাষিক আগ্রাসনের শিকার হয়েছেন এমন কিন্তু নয়। এর আগেও ১৯৫৪ সালের বাজেট অধিবেশনে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র রাজ্য ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। যদিও বিভিন্ন অন-অসমিয়া ভাষাগোষ্ঠী বিশেষত অসমে বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতিদের তীব্র বিরোধিতায় এই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। এভাবেই সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত ভাবে বারবার অসমিয়া ভাষা জোর করে চাপিয়ে দিয়ে মাতৃভাষার অধিকার খর্ব করার একটি অপচেষ্টা জারি ছিল। যা চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৬০ সালে এসে। সেই বছরের এপ্রিলে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস দলের সভায় কেবলমাত্র অসমিয়াকে রাজ্য ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব রাখা হয়। কাছাড় জেলার প্রতিনিধিদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও এই প্রস্তাবটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নামক প্রহসনের নিরিখে পাশ হয়ে যায়। মন্ত্রিসভাকে সিদ্ধান্তটি কার্যকরী করতে নির্দেশ দেওয়া হলে মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা মত প্রকাশ করেন যে, “রাজ্যে অন-অসমিয়া ভাষাভাষীদের মধ্যে থেকে এই প্রস্তাব এলে তা সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত রূপে গণ্য করা যেত।”2
অসমে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষী তথা অন্যান্য অন-অসমিয়ারা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে তাদেরকে চাপ দিয়ে এই সিদ্ধান্তটিকে মেনে নিতে বাধ্য করতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ওপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। যা কিছুদিনের মধ্যেই সারা রাজ্য জুড়ে ভয়াবহ দাঙ্গার রূপ নেয়। এই দাঙ্গার কারণ অনুসন্ধান করতে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। যার দায়িত্বে ছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি গোপালজি মেহরোত্রা।এই কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে এই ভাষিক দাঙ্গা ছিল সম্পূর্ণ সংগঠিত ও সুপরিকল্পিত –“I would therefore, hold that the disturbance of Goreswar were pre-mediated and not sudden . They were not sporadic but the operations were carried on in a systematic manner and there were some people behind the whole disturbances who had a clear idea of the pattern and method to be adopted and who had managed to get buses, trucks, jeeps and even fire-arms…”3
এমনকি সে সময়ে অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার গোরেশ্বর অঞ্চলে যে দাঙ্গা হয়েছিল তাতে পুলিশ প্রশাসন নিস্পৃহ থেকে পরোক্ষ ভাবে মদত যুগিয়েছিল বলেও এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যেই অসমিয়া ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্তে চূড়ান্ত সিলমোহরটি বসানোর চেষ্টা হিসেবে বিধানসভায় আনা হল ভাষা বিলের প্রস্তাব। এই বিলটিকে আপাতদৃষ্টিতে অসমে বসবাসকারী সকল ভাষাভাষির গোষ্ঠীর রক্ষাকবচ বলে মনে হলেও এর আড়ালে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। এই বিলের সাথে যুক্ত করে দেওয়া মহকুমা বিধিটি থেকে একথা স্পষ্ট যে আসলে বাংলা ভাষায় কাজকর্মের অধিকারকে কেড়ে নেওয়ার চক্রান্তেরই এটি ছিল একটি অংশ।
এই ভাষা আইনের প্রতিবাদে অসমের বরাক উপত্যকায় বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ১৯৬১ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে বরক উপত্যকার করিমগঞ্জ জেলায় শুরু হয় পদযাত্রা। গড়ে উঠে গণসংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯ মে তারিখে কাছাড় জেলায় সর্বাত্মক ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। এদিকে এইসব প্রতিবাদী কর্মসূচিতে শিক্ষক ও ছাত্রদের অংশগ্রহণে বাধা দিতে সরকারি ভাবে সার্কুলার জারি করা হয়। কিন্তু এসবের পরোয়া না করে দলে দলে ছাত্র- যুবক সাধারণ মানুষ যোগ দিলেন আন্দোলনে।
১৯ মে-র কর্মসূচিকে সফল করে তুলতে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়। ১৮-ই মে কাছাড় জেলার শিলচর শহরে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং আন্দোলনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। ১৯ মে তারিখে ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে ভোর থেকেই সত্যাগ্রহীরা করিমগঞ্জ এবং শিলচর রেলস্টেশন চত্বরে জড়ো হয়ে রেল অবরোধ করেন। শিলচর রেলস্টেশনে পুলিশ লাঠি চার্জ করলে আন্দোলনকারীদের অনেকে গুরুতরভাবে আহত হন এবং বেলা ২:৩৫-এ ষ্টেশন চত্বরে গুলি চালনায় ১১ জন আন্দোলনকারী শহীদ হন।
এরপরও সমাধান সূত্র সহজে মেলেনি বরং জটিলতা বাড়তে থাকে। প্রধানমন্ত্রী কিংবা তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও কোনও স্থায়ী সমাধান সূত্রে আসতে পারলেন না। পরবর্তীতে অবশ্য ভাষা আইনে সংশোধন আনা হয় শাস্ত্রীজির নির্দেশ মেনেই এবং কাছাড়ের ক্ষেত্রে কাজের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের অধিকার সুনিশ্চিত করা হয় – “Without prejudice to the provisions of section 3, the Bengali language shall be used for administrative and other official purposes upto and including the district level in the district of Cachar.”4
আমরা বাংলাদেশের ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা সংগ্রামের কথা জানি, যার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কো এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আজকে যখন সারা দেশ জুড়ে আধিপত্যবাদের রাজনীতি চরমে, যখন মানুষের বিভিন্ন অধিকারে নানা ভাবে হস্তক্ষেপ করার প্রবণতা বাড়ছে এবং অসমেও বর্তমানে নাগরিক পঞ্জী নবায়নের নামে যেভাবে হাজার হাজার বাঙালিকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, এরকম একটি সময়ে দাঁড়িয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি ১৯’র এই আন্দোলনের কথাও চর্চায় উঠে আসা একান্ত জরুরি।
১৯৬১-র ১৯ মে বরাক উপত্যকার শিলচর রেলস্টেশনে বাংলা ভাষা রক্ষার সংগ্রামে, আসাম সরকারের গুলিতে প্রাণ দেয় ১১ জন। আজকের আসামে যে নতুন করে ভাষা, ধর্ম ও জাতিবিভেদের প্রেক্ষাপট রচিত হচ্ছে, সেই ভয়ঙ্কর আগামীর অন্ধকার সময়ে, ১৯’র ভাষাশহীদের প্রেরণা আমাদের হৃদয়ে হৃদয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলুক।
1. https://legislative.assam.gov.in↩
2. বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস , সুবীর কর↩
3. বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস , সুবীর কর↩
4. https://legistative.asaam.gov.in↩
লেখক অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী।
অসাধারণ ইতিহাস! সমস্ত বাঙালির জানা উচিত ।