মে ডে উপলক্ষে পথে নামলেন কলকাতার যৌনকর্মীরা – শ্রমের অধিকারের দাবিতে। আলোচনায় উঠে এল নানা বিতর্ক ও পথের সন্ধান।
গ্রাউন্ডজিরো: গত ৩০শে এপ্রিল প্রায় ৪০০ জন যৌনকর্মী রাস্তায় নামলেন ১লা মে-র আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে মিছিল আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সূচি নিয়ে। সঙ্গে রইলেন ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি’, ‘আমরা পদাতিক’, ‘আনন্দম’ এবং আরও অনেকে। প্রান্তিক মানুষের অধিকার – বিশেষত কলকাতার যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছে এনজিও ‘দুর্বার ‘, আর তার ছায়ায় ক্রমশ গড়ে উঠেছে এলজিবিটি অধিকার নিয়ে ‘আনন্দম’ এবং যৌনকর্মীদের সন্তানদের অধিকার নিয়ে ‘আমরা পদাতিক’। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের হাতে ছিল ব্যানার, প্ল্যাকার্ড আর জনে-জনে বিলি করার জন্য প্যামফ্লেট; অনেকের পরনে হলুদ টি-শার্টে ঘোষিত যৌনকর্মীদের শ্রমের অধিকারের স্লোগান – নারী-আন্দোলনে এই অধিকারের গুরুত্বের কথা। দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রীটের শীতলা মন্দির ঘেঁষা জমায়েত থেকে মিছিল বেরোল বিকেল ৪টেয়, চলল প্রায় ঘণ্টা দেড়েক, কোম্পানি বাগান জংশন হয়ে শেষে ফের শীতলা মন্দির। তারপর আলাপ-আলোচনা হল শুধু যৌনকর্মীদের সামাজিক দুর্নাম ও তাঁদের উপর অসাম্যের বিরুদ্ধেই নয়, তাঁদের কাজকে শ্রম হিসেবে চিহ্নিত করার দাবিতে – অর্থাৎ একজন শ্রমিক আইনত যা যা সরকারি সুযোগসুবিধা পেতে পারেন – তার দাবিতে, ‘ইম্মরাল ট্র্যাফিকিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট’-এর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সংশোধনের দাবিতেও।
মিছিল-পরবর্তী অনুষ্ঠানে ‘দুর্বার’ ছাড়াও ‘টিইউসিসি’, ‘শ্রমজীবী স্বীকৃতি মঞ্চ’, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল এনজিও ফোরাম’, ‘দশ থেকে দশ হাজার’, ‘কর্মজীবী মহিলা পরিষদ’ প্রভৃতি নানান এনজিও, গোষ্ঠী, ট্রেড ইউনিয়নের সমাবেশে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কথা উঠে এল। আশাবাদী বক্তব্য শোনা গেল কীভাবে এই প্রতিবাদ যৌনকর্মীদের আইনি এবং সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য-সম্মানের পাশাপাশি প্রাত্যহিক নিরাপত্তা এনে দিতে পারে, স্থানীয় গুন্ডা-দালাল ও যৌনব্যবসার সবচাইতে লাভজনক প্রান্তে অবস্থিত যাঁরা লাভের গুড় খেয়ে যান, তাঁদের হাত থেকে বাঁচবার পথও খুঁজে দিতে পারে। ‘শ্রমজীবী স্বীকৃতি মঞ্চ’-এর কনভেনার রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী জানালেন বিনোদিনী শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে একত্রিত ভাবে তাঁরা বিড়ি-শ্রমিক, জরি-শ্রমিক, নির্মাণ-শ্রমিকদের মতো সামাজিক ভাবে স্বীকৃত অসংগঠিত শ্রমিকদের পাশাপাশি যৌনকর্মীদেরও সংগঠিত শ্রমিকের মর্যাদা দেবার দাবিতে কাজ চালিয়ে গেছেন। মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন এমন কিছু মানুষও, যাঁরা কোনো গোষ্ঠীর সদস্য নন – এসেছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রতিবাদে গলা মেলাতে। অনুষ্ঠান শেষ হল কবিতায়, ‘দুর্বার’-এর সাংস্কৃতিক শাখা ‘কোমল গান্ধার’-এর নাচে, ‘দুর্বার ব্যান্ড’-এর জমাটি গানে।
১৯৯৭ সাল থেকে শ্রমের অধিকারের দাবিতে কলকাতার যৌনকর্মীরা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন মিছিল ও পিটিশনের মাধ্যমে – নানান আইনি পথে। ‘গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই’, ‘যৌনকর্মীর অধিকার, নারী-আন্দোলনের হাতিয়ার’ – পোস্টারে লিখেছেন তাঁরা; বারবার পথে নেমেছেন – যেমন ২০০৮ সালে কয়েকশ’ যৌনকর্মীর মিছিল কলকাতা শহরকে চমকে দিয়েছিল। কিন্তু এই মিছিলের লক্ষ্য কি শুধুই ‘দৃশ্য’ হয়ে ওঠা? অথবা, আইনি ভাবে শ্রমের অধিকার পেলেই কি তাঁদের সব সমস্যার সমাধান ঘটে যাবে?
আসলে যৌনকর্মীদের রুজিরুটির সাথে শ্রমের সংজ্ঞার সম্পর্ক নিয়ে তর্কবিতর্ক তো তাঁদের নিজেদের অজানা নয় – বরং জটিল আত্মিকতার সঙ্গে জানা, কারণ এ বিষয়টা তাঁদের কাছে তাত্ত্বিক সমানাধিকার নয়, বাস্তব প্রশ্ন। বৃহত্তর সমাজের অবমাননা-অনুকম্পার পাশাপাশি তাঁদের অধিকাংশকেই ঢেলে সাজাতে হয় সংসারের সংজ্ঞা, কাছের মানুষদের সাথে সম্পর্কের সংজ্ঞা। অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবে যে আর্থিক, আইনি ও স্বাস্থ্যবিষয়ক নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি তাঁদের হতে হয়, তার তীব্রতাও অন্যান্য স্বীকৃত শ্রমজীবীদের সমস্যার চাইতে ভিন্নস্তরের। এর সাথে রয়েছে শিক্ষার সুযোগের অভাব, নানান আর্থিক-শারীরিক-মানসিক শোষণ। অথচ অসাম্যের শিকার এবং সমানাধিকারবাদী আন্দোলনের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও বৃহত্তর নারী-আন্দোলন ও শ্রমিক-আন্দোলনে তাঁদের স্বীকৃতির অভাব রয়ে গেছে অনেকটাই – নেতৃত্বের সম্মান পাওয়া তো দূরের কথা। এসব মাথায় নিয়েই, সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাবার কঠিন কাজটা করার বদলে সেই সমাজের প্রান্তিক মানুষদের বিনা বিকল্প ব্যবস্থায় পেশাচ্যুত করা, রাষ্ট্রীয় আয়ব্যায়ের হিসেবনিকেশ থেকে তাঁদের বহিষ্কৃত করার সহজ রাস্তাটার বিরুদ্ধে তাঁরা নিয়মিত ভাবে প্রতিবাদ চালিয়ে আসছেন। খতিয়ে দেখলে, তাঁদের এই আন্দোলনের সম্পর্ক রয়েছে জল-জঙ্গল-জমি বাঁচাও আন্দোলনগুলির সাথেও, কারণ রাষ্ট্রের গণবিরোধী উন্নয়ন-নীতি মানুষ ও পরিবেশকে পিছু হাঁটাতে হাঁটাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়, ঘটে ব্যাপকতর নগরায়ন, জীবিকা-ব্যবস্থার নতুন বিভাজন, সামাজিক-অর্থনৈতিক রূপান্তর – যার শিকার হন নারীরা, শিশুরাও। সাধারণ ভাবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও অর্থনীতির কুপ্রভাবের পাশাপাশি যৌনকর্মীদের একটা বড় অংশ কিন্তু এই বৃহত্তর আগ্রাসী বাণিজ্যমুখী অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারও ফসল। সেই অর্থে, যৌনকর্মীদের এই বাৎসরিক প্রতিবাদের গভীরে থেকে যায় নানা সম্ভাবনা, নতুন ভিন্নধারার রাজনৈতিক জোটের সূচনার আভাস, যা নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন থেকে যায় – তা যেকোনো মানবতাবাদী আন্দোলনের নিরিখেই হোক।
হয়তো এই প্রতিবাদের পথে এখনই উঠে আসছে না কোনো সরল গঠনমূলক উত্তর, কিন্তু উঠে আসছে বিনা প্রতিবাদে অধিকার কাড়াকে মেনে না নেওয়াটুকু। এই ‘মে ডে’তেও শ্রমিকশ্রেণির অধিকারের নানান ভাষ্যের ভিতর সেই না মেনে নেওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ রেশ রয়ে গেল।