মারুতি কারখানার ১৩ শ্রমিকের যাবজ্জীবন: তবু,আজও মুছে যায়নি মে দিবসের স্বপ্ন


  • May 1, 2018
  • (0 Comments)
  • 3714 Views

রামনিবাস

প্রতি বছরের মত এই বছরও বিশ্ব জুড়ে মেহনতি মানুষ মে দিবস উদযাপন করছে। ১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরে দিনে সর্বাধিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে মানুষ সংঘর্ষে নামে, এবং আত্ম-বলিদান দেয়। তারই ফলে আজকের দিনেও খেটে খাওয়া মানুষ তাদের অধিকারের সুরক্ষা পাচ্ছে। শ্রম আইন নথিভুক্ত হওয়ার আগে কাজের কোনও নির্ধারিত সময় সীমা থাকত না। কল-কারখানায় দিনে ১৮-২০ ঘণ্টা খাটিয়ে নেওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার ছিল। এই ভয়াবহ শোষণ ও নিপীড়ণের বিরুদ্ধে মানুষ একজোট হয়ে রাস্তায় নেমেছিল। ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন শাসক শ্রেণি শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ওপর গুলি-বোমার হামলা করে তাদের ভয় দেখাতে চায়, শ্রমিক নেতাদের খোলা রাস্তার ওপর খুন করা হয়, ফাঁসিতে চড়ানো হয়। কিন্তু তাতেও দমে যায়নি খেটে খাওয়া মানুষের দল। শাসকের থেকে ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার আদায় ক’রে ছাড়ে।

এই বিপ্লবের থেকে প্রেরণা নিয়েই আজও শোষিত, অবদমিত, গায়ে-গতরে খাটা মানুষ নিজের অধিকারের দাবিতে লড়ে যায়। দুঃখের বিষয় যে, আজকের দিনে দাঁড়িয়েও পুঁজিবাদী মুনাফাখোরেরা শ্রমিকদের থেকে ১২ ঘণ্টার শ্রম আদায় করছে। ৮ ঘণ্টা শ্রমের মূল্য বাবদ এত কম টাকা দেওয়া হচ্ছে যে, দিন গুজরান করার জন্য মানুষ ১২-১৬ ঘণ্টা শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে।

২০১১ সালে যখন মানেসর-এ মারুতি কোম্পানিতে প্রথম বার মে দিবসের কথা বলা হয়, তখন এক এক জন শ্রমিক নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে নিজেদের সৈনিকের মত প্রস্তুত করেছিল। যখন ওরা জানতে পারে যে, আগে কাজের নির্দিষ্ট সময় সীমা ছিল না এবং আমেরিকায় দলে দলে শ্রমিক বিশাল ধর্মঘটে সামিল হয়ে এবং নিজেদের প্রাণ দিয়ে অধিকারের প্রশ্নে লড়ে গেছে, তখন মারুতির শ্রমিকদের মধ্যেও প্রত্যাশা জাগে। তারাও লেবার ইউনিয়ন গঠনের কথা ভাবে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে খেটে খাওয়া মানুষ নিজেদের পরিবার-পরিজনদের ছেড়ে লাল নিশানের লড়াইয়ের জন্য প্রাণপাত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। নিজেদের মধ্যে সমস্ত রকম বিভেদ ভুলে শুধুমাত্র অধিকারের জন্য একজোট হয়ে লড়তে থাকে। মালিক পক্ষ বিভিন্ন ধরনের ভেদাভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করলেও, সফল হয় না। হরতালরত শ্রমিকের পরিবারের সদস্যরা তাদের বাড়ি ফেরার অনুরোধ করলে তারা জানিয়ে দেয়, এটাই এখন তাদের পরিবার এবং আন্দোলনে সামিল ভাইদের ছেড়ে তারা কোথাও যাবেনা। আন্দোলনের সময় নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া এতটাই গভীর হয়ে যায় যে, স্থায়ী কর্মীরা ঠিকে কর্মী এবং শিক্ষারত কর্মীদের ছোট ভাইয়ের মতো দেখত এবং আগলে রাখত। এই একতার ফলে মানেসর প্লান্ট-এ শ্রমিকরা তিনটি দীর্ঘমেয়াদি হরতাল সফল ভাবে পরিচালনা করে এবং মারুতি কর্তৃপক্ষকে শ্রমিক ইউনিয়ন নিবন্ধভুক্ত করার দাবি মেনে নিতে বাধ্য করে।

১লা মার্চ, ২০১২ সালে লাল ঝান্ডাকে সাক্ষী রেখে শ্রমিকরা নিজেদের সাফল্যের উৎসব উদযাপন করেছিল। সেদিন সাফাই কর্মী থেকে শুরু করে উৎপাদনে কাজ করা শ্রমিক সবাই এক অভূতপূর্ব স্বাধীনতার আভাস পায়। হরতালের সময় উঠে আসা “মজদুর মজদুর – ভাই ভাই” স্লোগান এত দিনে সত্যি হয়ে গিয়েছিল। যেরকম গুড কন্ডাক্ট বন্ডে সই করার পর স্থায়ী শ্রমিকরা অস্থায়ী শ্রমিকদের জন্য হরতাল করেছিল, সেই রকম-ই ইউনিয়নের দাবির খসড়ার প্রথম ভাগেই স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মীদের মধ্যে সমান কাজ এবং সমান বেতনের দাবি তোলা হয়। সেই দাবি মালিক পক্ষ মেনে না নেওয়ায় অন্য কোনও দাবি নিয়ে কথা বলতে নারাজ হয় ইউনিয়ন পক্ষ। মালিক পক্ষ বুঝে গিয়েছিল শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে এই অনড় একতা তাদের কাজের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাই ১৮ জুলাই ২০১২ সালে ষড়যন্ত্র করে ইউনিয়নের নেতাদের সাথে ১৪৮ জন শ্রমিককে জেলে পাঠিয়ে দেয় আর ২৩০০ শ্রমিককে কাজ থেকে বহিষ্কার করে। মালিক পক্ষ বুঝতে পারে যে নিজেদের দাবি সম্পর্কে সচেতন শ্রমিকদের দিয়ে যেনতেন প্রকারে খাটিয়ে নেওয়া যাবে না, তাই সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, শ্রম আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শ্রমিকদের ছাঁটাই করে। ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকরা তাঁদের লড়াই এখনো পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। কোম্পানি নতুন করে প্ল্যান্ট চালু করে কিন্তু হরিয়ানার মানুষদের আর কাজ দেওয়া হয় না। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ভাষাভাষী শ্রমিকদের নিয়োগ করা হয় যাতে তারা নিজেদের মধ্যে সামান্য কথাও না বলতে পারে। এইভাবে একজোট হওয়ার সম্ভাবনা ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়। ঠিকে কর্মীদের ৬ মাসের বন্ডে নিয়োগ করা হতে থাকে, এর ফলে ঠিকে মজুরদের মধ্যে এমন একটা মানসিকতা তৈরি হয় যে, তাকে তো ৬ মাস পরে কোম্পানি ছেড়ে চলে যেতেই হবে, লড়াই করে কী লাভ!

যেখানে সারা দুনিয়ার মানুষ মানেসর প্লান্টের শ্রমিকদের একতার কথা জেনে গর্ব বোধ করে, সেই মানেসর প্লান্টেই এখন শ্রমিকদের ঐক্য একটা বিরাট প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। অনেক চেষ্টার পরেও শ্রমিক শ্রেণিকে ঐকবদ্ধ করা মুশকিল হয়ে পড়ছে। কর্মীদের মধ্যে বিভাজন বাড়ানোর জন্য তাদের বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে হয়েছে: স্থায়ী, ট্রেনিং, টেম্পোরারি ওয়ার্কম্যান, প্রতীক্ষারত, ঠিকা, কোম্পানি ক্যাজুয়াল ইত্যাদি। এদের কাউকে ৭-৮ মাসের জন্য নিয়োগ করা হয়, কাউকে ১-২ বছরের জন্য।

আজ শ্রমিক দিবসে যখন আমরা ২০১১ সালকে স্মরণ করি, মনে হয় ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মাঝপথে হারিয়ে গেছে। এবং তা ফিরিয়ে আনাটাই আমাদের সামনে মোক্ষম চ্যালেঞ্জ। এই লড়াইতে কোনো খামতি ছিল না, জোশ কম ছিল না শিকাগো শহরের লড়াইয়ের চেয়ে, আজও ১৩ জন শ্রমিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। তারা জেলের ভিতর দিন গুজরান করছে। আজও শয়ে শয়ে শ্রমিক রাস্তায় নেমে লড়ে যাচ্ছে নিজেদের অধিকারের দাবিতে। প্রচুর শ্রমিক মানেসরের লড়াইয়ের গর্বের ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে প্রস্তুত আর একটা নতুন ইতিহাস গড়ে তুলতে। আজও মে দিবস আমাদের প্রেরণা দেয় এবং অবদমনের শৃঙ্খল ভেঙে নতুন ইতিহাস লেখার ভাবনাকে উদ্বুদ্ধ করে। আরো একবার আমাদের এক হয়ে বিরোধী শক্তির বিভাজনের রাজনীতিকে ধূলিসাৎ করে, নিজেদের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ ভুলে এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমিক শ্রেণি যেন হয়ে ওঠে আমাদের একমাত্র পরিচয়, যার জোরে আমরা নতুন সংঘর্ষ জারি করতে পারব মুনাফখোর, অত্যাচারী, শোষক মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে।

লেখক মারুতি কারখানার ছাঁটাই শ্রমিক। মূল হিন্দি রচনা থেকে অনুবাদ করেছেন পাঞ্চালী কর।
Share this
Leave a Comment