গ্রাউন্ডজিরো বিশেষ সংবাদদাতা: ‘স্বভাব’ দলের নতুন নাটক ‘রাখে নদী মারে কে’-র প্রথম শো হয়ে গেল গত ২২-শে এপ্রিল, বসুন্ধরা দিবসে, সায়েন্স সিটির ন্যানোল্যাব পরিচালিত এক অনুষ্ঠানে। আয়োজকরা ছাড়াও ছিলেন সত্তর-আশিজন বিভিন্ন স্কুলের নানা ক্লাসের ছাত্রছাত্রী আর তাঁদের মা-বাবারা। দর্শকরা গল্পের কতখানি ভিতরে ঢুকে যেতে পারছিলেন, তা বোঝা গেল শুধু অভিনয়ের তালে তাল মিলিয়ে হাসি, গানের সাথে মাথা দোলানো, বা শেষের হাততালি থেকেই নয়; আলাদা ভাবে অনেকেই এসে জানালেন তাঁদের ভাল লাগার কথা। ব্যক্তিগত পরিসরে আলোচনা হল, কীভাবে জ্ঞান দেবার ঢঙে নয়, কথকতার ঢঙে এই নাটক নদীর জলের রাজনীতি ও অর্থনীতি, ব্যবহার ও অপব্যবহার নিয়ে কথা বলছে, পরিবেশ ও সমাজের উন্নয়নের নামে ‘প্ল্যানিং’-এর খাঁটি-গলদ বিচার নিয়ে তথ্য তুলে ধরছে – এমন তথ্য, যা স্কুলের পরিবেশ-বিজ্ঞান বইতে পাওয়া যায় না, অথচ যা আমাদের দেশজ জ্ঞানভাণ্ডারের ফসল, সত্যিকারের মানবতাবাদী ব্যবহারিক বিজ্ঞান।
নাটকের গল্প এক নদীকে নিয়ে। নদীর নাম শিবনাথ। বোতলবন্দী করে এ দেশের নদীর জলকে ‘পানীয়’ বানাবার ইতিহাসে একদম গোড়ার দিকে সত্যিই নাম পাওয়া যায় এই নদীটির। তো সেই নদীকে পাইপলাইনে বেঁধে, তার জলকে সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার নামে ব্যবসার কুচক্রী পরিকল্পনা করা হয় এই নাটকে। কীভাবে ঠেকানো যাবে এই ‘হাই-টেকনিক স্কীম’? কারা ঠেকাবে? আদৌ ঠেকানো যাবে কী? যায় কখনও? পৃথিবীর কোণে-কোণে নির্লজ্জ থাবা বাড়িয়ে যারা পরিবেশের সর্বনাশ করে, আমজনতার-চাষির-শ্রমিকের বাঁচা-মরা-চাওয়া-পাওয়া নিয়ে রাজনীতি করে, আর্থিক-যান্ত্রিক-বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের কুমীরছানা দেখিয়ে নিজেদের পেট-পকেট ভারি করে, তেমনই এক ঠাকুরমার ঝুলির ধূর্ত ভুঁড়ো শিয়ালের মত দুর্দান্ত এই গল্পের ‘ভিলেন’।
আসলে এ নাটকে ‘এন্টারটেইনমেন্ট’-এর বেশ ধরে বারবারই উঠে এসেছে লৌকিক রূপকথার ছন্দ, দুপুর-শহরের স্মৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া শনিবারের রেডিওর যাত্রাপালার সুর, রুপোলি পর্দার বিজ্ঞাপন-নাচগান-কমেডির ধাঁচে নির্মিত দৃশ্যরূপ: দর্শকের চোখ-কান-মাথা টেনে রাখবার অস্ত্র। নাটকের বিষয় বর্তমান সময়ের এক তীব্র বাস্তব সমস্যা বটে, কিন্তু এ নাটক শুধু অনুযোগই করে না, সমাধানের সন্ধানও করে – তাই এর রূপায়ন ব্যাঙ্গধর্মী নয়, রূপকধর্মী। নাটকের ‘পারফর্মেন্স’ অন্তরঙ্গ পরিসরে, যেখানে দর্শক-অভিনেতা চোখে চোখ রেখে ভাব বিনিময় করতে পারেন: পাইপলাইনে আটকা, গা ফেঁপে ওঠা শিবনাথের যখন সমস্ত ভাসিয়ে সম্বিৎ ফেরে, আর সামনের সারির দর্শকদের দিকে আঙুল তুলে সে ছুটে যায় এটা বুঝে নিতে, যে কেন এই সর্বনাশী বন্যার দিনে কারুর হৃদয়ে সব ভেসে যাবার হতাশ্বাস, অথচ কারুর পকেটে বন্যা-পরবর্তী কনস্ট্রাকশন আর রিলিফের কনট্র্যাক্ট, তখন একদিকে নাটকের ভিতরে যেমন অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয় নদীর বন্ধু ফড়িং-মাটি-জঙ্গল, তেমনি আরেকদিকে নাটকের বাইরে বাচ্চাদের মুখ যায় শুকিয়ে। প্রতি বছর পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বন্যাবিধ্বস্ত অবস্থা, জলের অভাবে মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের কৃষিব্যবস্থার সর্বনাশ – এ হয়তো তারা জানে না, বা শুনেছে ভাসাভাসা। হয়তো বন্যা আর জলাভাবের পিছনের রাজনীতি-অর্থনীতি তেমন জলের মত পরিষ্কার নয় বহু প্রাপ্তবয়স্ক দর্শকের কাছেও। তবু, পুরোপুরি না বুঝলেও গল্পের টানে ভালমন্দের মূলটুকু বুঝে নিতে বয়স বা তথ্যের অভাব কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। নাটকের ডায়লগ ধার করে বলতে গেলে বলতে হয় – “ছোট বড় মেজ সেজ সিকি আধুলি, আফগানিস্তান থেকে আমতা, কেনিয়া টু কাকিনাড়া, প্রধানমন্ত্রী থেকে পাশের বাড়ি” – এই নাটক হয়তো আমাদের সব্বার বোধশক্তি-চিন্তাশক্তির উপর কোনো না কোনো ভাবে ঘা দেবে – কারুর বা “জিতে নেবে দিল”, কারুর হয়তো “ঘেঁটে দেবে ঘিলু”!
প্রায় দেড়-দু’ বছর পর ‘স্বভাব’ নতুন নাটক নিয়ে পথে নেমেছে। বাংলায় আর হিন্দিতে সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে ভিন্নধারার নাটক দল হিসেবে তাদের পরিচিতি। রাজনৈতিক নাটক-জগতের শহরকেন্দ্রিক, তত্ত্বকেন্দ্রিক এক অংশের তথাকথিত ‘শস্তা এন্টারটেইনমেন্ট’-বিরোধিতার নামে সাংস্কৃতিক আভিজাত্যের লেজ চেপে ধরে রাখবার যে ধারা, গত প্রায় এক দশক ধরে ‘স্বভাব’ নিজেকে তার বিপরীতে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছে। হালের নাটকেও সেই ছাপ পরিষ্কার। তাছাড়া ‘পরিবেশ’-এর রাজনীতি, যা মূলস্রোতের রাজনৈতিক আন্দোলনে হয়তো বা কিছুটা ব্রাত্য, তাকে কেন্দ্র করে নাটক করার সিদ্ধান্তের পিছনেও রয়েছে লোকায়ত রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়ে তাদের নিজস্ব এক অবস্থান। আসলে ‘স্বভাব’-এর গোড়াপত্তন থেকে আজ অব্দি যে পথ চলার গল্প, তা বাংলার আধুনিক সাংস্কৃতিক জগতের নানান দিক নিয়ে ভাবায়। ‘স্বভাব’ যখন এক ‘ক্রিয়েটিভ লার্নিং সেন্টার’ হিসেবে গড়ে ওঠে ২০০৮ সালে, তাদের মূল ভাবনাটি ছিল বিকল্প শিক্ষা ও জীবনযাপন পদ্ধতির চর্চা। এখানে শ্রেণী-জাতি-লিঙ্গ-ধর্মের ভেদাভেদকে তো মানা হয় না বটেই, চর্চা হয় আরও এক উপেক্ষিত যাপনের – গুণের মাপে মানুষের ভেদাভেদকে না মানা। গুণ-প্রতিভা-দক্ষতা-বুদ্ধিবৃত্তির বিচারও তো আসলে সামাজিক-রাজনৈতিক উঁচুনীচু বিচারের বাইরে নয়, অথচ এই ভেদাভেদ আমাদের চিন্তাভাবনার – বিশেষত আধুনিক সাংস্কৃতিক জগতের পরিচালন পদ্ধতির কতটা গভীরে ঘাপটি মেরে থাকে, তা আমাদের অজানা নয়। ‘স্বভাব’ এই জায়গায় তার লড়াইটা নিজেদের মত করে যথাসম্ভব চালিয়ে আসছে। তাই এখানে মূল্য দেওয়া হয় শুধু নিজেদের কাজের প্রতি, ভাবনার প্রতি ভালবাসা আর দায়িত্ববোধকে, যা না থাকলে এই বস্তুতান্ত্রিক, ক্ষমতাতান্ত্রিক, ধ্বংসতান্ত্রিক অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজনীতির দুনিয়ায় কোনো ভিন্নধারার কাজই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মানুষের মুখে-মুখে চলে আসা সাধারণ জ্ঞান যে ইংরিজি বইতে লেখা শহরমুখী উন্নয়নের তত্ত্বের চাইতে বড় বই ছোট নয়, প্রকৃতির বুকে খেটে খাওয়া মানবগোষ্ঠীর স্বাভাবিক দায়িত্ববোধ থেকে উঠে এসেছে প্রকৃতির সাথে যে পারস্পরিকতা ও প্রীতির সম্পর্ক, তা যে তুচ্ছ নয় – এই বোধটুকুও ‘স্বভাব’-এর এই লড়াইতেই ঢুকে বসে রয়েছে। তাই ‘স্বভাব’-এর ইতিহাস মাথায় রাখলে, ‘রাখে নদী মারে কে’ নাটকে কাহিনীর প্রাথমিক স্তরকে ঘিরে নাটকের গঠন ও বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনার, রাজনৈতিকতার এইরকম কিছু জটিলতর স্তরও চোখে পড়বে, যার কিছুটা নিয়ে হয়তো বিতর্ক চলতেও পারে, কিন্তু যাকে হেলাফেলা করা যায় না।
ঘটনাচক্রে এই নাটক পথে নেমেছে এক বিশেষ মুহূর্তে। বসতি উচ্ছেদ আর ইমারত নির্মাণের চাকা শতকের পর শতক ধরে চলতে চলতে আজ মানবসভ্যতার ‘বিকাশে’র সাথে এক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিকাশ স্বভাবতই আমজনতার জন্য নয়, পরিবেশের জন্য তো নয়ই। এই বিকাশের আগ্রাসী, পরিবেশবিরোধী, মানবতাবিরোধী চেহারাটাকে রুখে দেবার ক্ষমতা কম লোকেরই থাকে। যাঁদের থাকে, তাঁদেরই একজন ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার-পরিবেশবিজ্ঞানী-নৃতত্ত্ববিদ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ – সেই ’৮১ সাল থেকে কাজ করে গেছেন পূর্ব কলকাতা ও বৃহত্তর কলকাতার জলা অঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে, দেশজ পদ্ধতির সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের ‘তালমেল’ ঘটিয়ে। ‘স্যুয়েজ ওয়াটার’ অর্থাৎ আপাত ভাবে নোংরা জলকে চাষের ক্ষেতে ব্যবহার করে স্বল্প খরচে শাকসব্জি-ফল-মাছ চাষের ব্যবস্থা এবং আরও নানা গবেষণায় ধ্রুবজ্যোতিবাবু ও তাঁর বিভাগের পরিশ্রম ছাড়া ‘হাই-টেকনিক’ উন্নয়নের চাকা হয়তো বহু আগেই কলকাতাকে পরিণত করত দিল্লি-ব্যাঙ্গালোরে – যেখানে খাদ্যের দাম কলকাতার স্থানীয় বাজারের চাইতে কয়েক গুণ বেশি, কারণ তা আসে বহু খরচায় ট্রাকে চড়ে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, বা মুম্বই-চেন্নাইতে, যেখানে উন্নয়নের ঠেলায় নদী শুকিয়ে পচা নালা হয়েছে – বৃষ্টি একটু বাড়লেই যেখানে মারণ-বন্যা দেখা দেয়। এই মানুষটি চলে গেলেন এ বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে; পূর্ব কলকাতার ভেড়ি ও জলা অঞ্চল, তাতে বসবাসকারী মানুষ-পশু-পাখি-মাছ-গাছপালা আজ তাই আরও বিপন্ন। এই অবস্থায় ‘রাখে নদী মারে কে’ কি ‘রাখতে’ পারবে তাদের কাউকে? হয়তো বা ন্যানোল্যাবের সেই সত্তর-আশিজন ছাত্রের মধ্যে কারুর-কারুর মনে থেকে যাবে এই নাটকের বিষয়বস্তু, হয়তো তাঁরাই একদিন কাঁধে তুলে নেবেন পৃথিবীকে, পৃথিবীর মানুষকে রাখবার ভার।
ছবি: শুভ্র প্রকাশ দাস