জাতপাতের মূলসূত্র : ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকর


  • April 14, 2018
  • (0 Comments)
  • 4993 Views

উর্দ্ধৃতাংশটি ১৯৫০-এর দশকে লেখা ড. বাবাসাহেব আম্বেদকরের প্রস্তাবিত গ্রন্থ ‘ক্যান আই বি আ হিন্দু’-র প্রথম ও একমাত্র লিখিত চ্যাপ্টার  ‘সিম্বলস্ অফ হিন্দুইজম’’থেকে নেওয়া। অনুবাদ: কাঁকর দাস

 

 

একজন প্রাচীন সংশয়বাদী তাঁর দার্শনিক অনুভব এককথায় প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছিলেন :

আমি কেবল এটুকুই জানি যে আমি কিছুই জানিনা; এবং সেটাও জানি কিনা আমি খুব নিশ্চিত নই …..’

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে স্যার ডেনজিল ইব্বেটসন তাঁর ‘পাঞ্জাব কাস্টস্’ গ্রন্থে পাঞ্জাবের জাতগুলোর উপর লেখার সময়  জাতপাত ব্যাপারটা যে আসলে কী, ব্যাখ্যা করতে চেয়ে তাঁর অনুভূতির যে প্রকাশ করেছিলেন, তা  ওই সংশয়বাদী দার্শনিকের সংশয়ের সঙ্গে হুবহু এক। সন্দেহ নেই, স্থানীয় পরিস্থিতির বিভিন্নতার কারণে জাতের ব্যাপারে কিছু কিছু স্থানিক পার্থক্য দেখা যায় এবং কোনও একটা জাতের সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও বিবৃতি দেওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে হতেই পারে, কোনও একটা জায়গার কোনও একটা জাতের ক্ষেত্রে যেটা খুবই সত্য, অন্য কোনও জায়গার ওই একই জাতের ক্ষেত্রে সমান সত্য দিয়ে ব্যাপারটার মোকাবিলা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

 

সমস্যাটা আছেই, তবু জাতপাতের মূখ্য ও মৌল বৈশিষ্ট্যগুলোকে এর গৌণ ও আলগা বৈশিষ্ট্যগুলোর থেকে আলাদা করে নেওয়া কঠিন হবে না। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার একটা সহজ উপায় হল প্রশ্ন করা যে কী কী কারণে কোনও একজন ব্যক্তিকে তার জাতের গণ্ডি থেকে বহিষ্কার করা হয়। 1896 খ্রিস্টাব্দে যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘হিন্দু কাস্টস্ অ্যান্ড সেক্টস্’ বইতে জাতচ্যুত বা একঘরে হওয়ার নিম্নোক্ত ন’টি কারণকে চিহ্নিত করেছেন। (১) খ্রিস্টধর্মে বা ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়া (২) ইওরোপে বা আমেরিকায় যাওয়া (৩) বিধবাকে বিয়ে করা (৪) প্রকাশ্যে পৈতে ত্যাগ করা (৫) প্রকাশ্যে গরু, শূয়োর বা মুরগি খাওয়া (৬) প্রকাশ্যে মুসলমানের, খ্রিস্টানের বা নীচু-জাতের হিন্দুর রান্না করা কাঁচা খাবার খাওয়া (৭) অত্যন্ত নীচু-জাতের শূদ্রের বাড়িতে ক্রিয়াকর্ম করা (৮) মহিলার ক্ষেত্রে অনৈতিক উদ্দেশ্যে বাড়ির বাইরে যাওয়া (৯) বিধবার ক্ষেত্রে গর্ভবতী হয়ে পড়া। এই তালিকা মোটেই পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠেনি, কারণ জাতচ্যুত হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি কারণকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সেগুলো হল (১০) জাতের বাইরের কাউকে বিয়ে করা (১১) জাতের বাইরের কারোর সঙ্গে একই পঙক্তিতে ভোজন করা (১২) জাতের জন্য নির্দিষ্ট পেশার পরিবর্তন করা। শ্রী ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় ত্রুটিটা হল, তিনি মৌল আর গৌণ কারণগুলোর মধ্যে কোনও বিভাজন করতে পারেননি।

 

অবশ্যই, যখন একজন ব্যক্তিকে জাতচ্যুত করা হয়, শাস্তিটা সবসময়ই এক থাকে। তার বন্ধুরা, আত্মীয়রা, স্বজাতের লোকেরা তার আতিথ্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। তাদের বাড়ির আনন্দঅনুষ্ঠানে তার নেমন্তন্ন থাকে না। সে নিজের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য কনে বা বর খুঁজে পায় না। এমনকি তার বিবাহিত কন্যারাও জাতচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে বাপের বাড়ি আসতে পারে না। তার পুরুত, তার নাপিত, তার ধোপা আর তার বাড়ির কাজ করে দেয় না। তার স্বজাতের লোকজন তার সঙ্গে সম্পর্ক এতটাই সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন করে দেয় যে, এখন তার বাড়ির কেউ মারা গেলেও, তারা শ্মশানযাত্রার সঙ্গী হয় না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে, জাতচ্যুত ব্যক্তিকে মন্দিরে ঢোকার ও শ্মশানে সৎকারের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়।

 

জাত থেকে বহিষ্কারের কারণগুলো পরোক্ষভাবে জাত ব্যবস্থার নিয়মকানুনগুলোকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়। তবে সবক’টা নিয়মকানুন ততটা মৌল নয়। ওগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই গৌণ নিয়ম। ওগুলো না থাকলেও জাতপাত থাকতে পারে। মৌল আর গৌণ নিয়মগুলোকে আলাদা করা যাবে অন্য একটা প্রশ্ন তুলতে পারলে। কখন একজন জাতচ্যুত হিন্দু তার নিজের জাত ফিরে পেতে পারে ? একজন হিন্দু যে নিজের জাত থেকে বিতাড়িত হয়েছে, কিছু কিছু শাস্তি ও কৃচ্ছসাধন করলে তাকে পুনরায় জাতে ফিরিয়ে নেওয়ার বিধান আছে, যার নাম প্রায়শ্চিত্ত। এই প্রায়শ্চিত্ত তথা কৃচ্ছসাধনগুলোর ব্যাপারে কয়েকটা কথা মনে রাখা দরকার। প্রথমত, কিছু কিছু জাতগত নিয়ম ভাঙলে, ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কোনও প্রায়শ্চিত্ত নেই। দ্বিতীয়ত, নিয়মভঙ্গের গুরুত্বের উপর নির্ভর করে প্রায়শ্চিত্তের কঠোরতা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, প্রায়শ্চিত্তে থাকে অল্প শাস্তি। অন্য ক্ষেত্রে প্রায়শ্চিত্ত কঠোর ও নির্মম।

 

প্রায়শ্চিত্ত করে ফিরিয়ে নেওয়ার বিধান থাকা না থাকার তাৎপর্যটা ভাল ভাবে বুঝে নিতে হবে। প্রায়শ্চিত্তের বিধান নেই মানে এই নয় যে, কোনও একজন খেয়ালখুশি মতো ওই নিয়মগুলো ভাঙতে পারে। বরং উল্টোটাই। প্রায়শ্চিত্তের বিধান নেই মানে অপরাধ এতটাই সাংঘাতিক যে, বহিষ্কৃত অপরাধীকে আর কোনও মূল্যেই স্বজাতে পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব নয়। যে জাত থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে তার পুনর্ভুক্তি নিষিদ্ধ। আর প্রায়শ্চিত্তের বিধান আছে মানে তার অপরাধ মার্জনার যোগ্য। অপরাধী সেক্ষেত্রে অনুমোদিত প্রায়শ্চিত্ত সংঘটিত করতে পারে এবং যে জাত থেকে সে বহিষ্কৃত হয়েছিল, সেই জাতে পুনরায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতে পারে।

 

দু’রকম অপরাধের জন্য কোনও প্রায়শ্চিত্ত নেই। এ দু’টো হল (১) হিন্দু ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরণ আর (২) অন্য জাতের বা অন্য ধর্মের ছেলেমেয়ের সঙ্গে বিবাহ। এটা খুব স্পষ্ট, একজন ব্যক্তি ওই দুই কারণে জাত খোয়ালে, সে চিরকালের জন্য খোয়াল।

 

অন্য অপরাধগুলোর মধ্যে আরও দু’টোর ক্ষেত্রে কঠোরতম প্রায়শ্চিত্তের বিধান –(১) অন্য জাতের বা অন্য ধর্মের কোনও ব্যক্তির সঙ্গে পঙক্তিভোজন এবং (২) স্বজাতের পেশা ছেড়ে অন্য জাতের পেশাগ্রহণ।

 

এছাড়া অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি অল্প, প্রায় নেই বললেই চলে।

 

তো, জাতপাতের মৌল নিয়মাবলী এবং জাত কীসের মধ্যে সেঁধিয়ে বসে আছে, তার তল্লাশি চালানোর নিশ্চিত ক্লু হল প্রায়শ্চিত্ত। জাতপাতের নিয়মকানুন লঙ্ঘন করলে যে যে ক্ষেত্রে প্রায়শ্চিত্তের বিধান নেই, সেগুলো হল জাত ব্যবস্থার আত্মা, এবং যে যে ক্ষেত্রে প্রায়শ্চিত্তের বিধান কঠোরতম, সেগুলো হল জাত ব্যবস্থার শরীর। কোনওরকম দ্বিধা না রেখেই তাই বলে দেওয়া চলে – জাত ব্যবস্থার মূখ্য বা মূল বাঁধন চারটি। জাত হল এমন একটি সামাজিক গোষ্ঠী যার সদস্যরা (ক)হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ও হিন্দু ধর্মের (খ) বিবাহ (গ) খাদ্যগ্রহণ প্রণালী ও (ঘ) পেশা নির্বাচন সংক্রান্ত নির্দিষ্ট নিয়মকানুনের নিগড়ে বাঁধা।

 

এর সঙ্গে আর একটি বৈশিষ্ট্য যোগ করা যেতে পারে। তা হল এই সামাজিক গোষ্ঠীটির অবশ্যই একটি সাধারণ নাম থাকতে হবে, যা দিয়ে গোষ্ঠীটিকে চিনতে পারা যাবে।

 

বিবাহের ব্যাপারে নিয়ম যে, জাত হবে অন্তর্গামী (এন্ডোগ্যামাস)। অন্য জাতের ছেলে মেয়ের মধ্যে অন্তর্বিবাহ মানা। এটাই হচ্ছে প্রাথমিক ও সবচেয়ে মৌল ধারণা যার উপর ভিত্তি করে জাতপাতের পূর্ণাঙ্গ অবয়বটা খাড়া করা হয়েছে। খাদ্যের ব্যাপারে নিয়ম যে, একজন ব্যক্তি নিজের জাতের নয় এমন কারোর থেকে খাদ্য গ্রহণ করবে না বা তার সঙ্গে এক পঙক্তিতে খাবে না। মানে দাঁড়াল যে, যাদের মধ্যে বিবাহ প্রশস্ত, তাদের সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া বিধিসম্মত। যারা বিবাহের যোগ্য নয়, তাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়াও নিষিদ্ধ। এক কথায়, জাত যেমন অন্তর্গামী গোষ্ঠী, তেমনই একইসঙ্গে অন্তর্ভোজী গোষ্ঠী। পেশার ক্ষেত্রে নিয়ম যে, একজন ব্যক্তি তার বংশগত পেশাকেই গ্রহণ করবে, আর যদি তার জাতের নির্দিষ্ট কোনও পেশা না থাকে তাহলে পিতার পেশাকেই নিজের পেশা হিসেবে সে বেছে নেবে। ব্যক্তির স্ট্যাটাস পূর্বনির্দিষ্ট এবং বংশানুক্রমিক। স্ট্যাটাস পূর্বনির্দিষ্ট কেননা একজন ব্যক্তির স্ট্যাটাস আসলে তার জাতেরই স্ট্যাটাস। স্ট্যাটাস বংশানুক্রমিক কেননা একজন হিন্দুর পিতামাতা যে জাতের, জন্মের সঙ্গেসঙ্গেই তার পিঠেও সেই জাতেরই স্ট্যাম্প পড়ে যায়। একজন হিন্দু তার স্ট্যাটাস বদলে ফেলতে পারে না, কারণ সে তার জাত বদলাতে পারে না। একজন হিন্দু একটি জাতের ভিতরে জন্মগ্রহণ করে, এবং যে জাতে জন্মায় আজীবন তারই সদস্য হয়ে থেকে তাকে মরতে হয়। একজন হিন্দু তার স্ট্যাটাস নষ্ট করে ফেলতে পারে, যদি সে তার জাত খুইয়ে বসে। কিন্তু সে কোনও নতুন স্ট্যাটাস বা উন্নততর স্ট্যাটাস বা অন্য স্ট্যাটাস অর্জন করতে পারে না।

 

জাতের একটা সাধারণ নামকরণের তাৎপর্যটা কী ? তাৎপর্যটা স্পষ্ট হবে যদি আমরা দু’টো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারি এবং সেই দু’টোর সঠিক উত্তর খুঁজে পাই, যা কিনা জাত ব্যবস্থার পূর্ণ ধারণা গড়ে তোলার জন্যে খুবই জরুরি। সামাজিক গোষ্ঠীগুলো হয় সংগঠিত নয় অসংগঠিত। যখন কোনও গোষ্ঠীর সদস্যপদ ও গোষ্ঠীটিতে যোগ দেওয়ার বা সদস্যপদ ত্যাগ করার পদ্ধতি নির্দিষ্ট সামাজিক নিয়মকানুন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, এবং পদ্ধতিটির মধ্যেই সম্পৃক্ত থাকে গোষ্ঠীটির অন্য সদস্যদের প্রতি কোনও একজন সদস্যের কিছু সুনির্দিষ্ট কর্তব্য আর অধিকারবোধ, তখন সেই গোষ্ঠীটি হয়ে ওঠে একটি সংগঠিত গোষ্ঠী। এই সংগঠিত গোষ্ঠী আবার এমনও হতে পারে, যেখানে সদস্যপদ গ্রহণটাও নিজের ইচ্ছা ব্যতিরেকেই ঘটে যেতে পারে, কেননা হয়তৌ সদস্যপদ গ্রহণের উপর সদস্যটির কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না, কেননা সেটা হয়তো ঐতিহ্য অনুসারী বা হয়তো বংশানুক্রমিক। উল্টোদিকে,  একটি গোষ্ঠী অসংগঠিত গোষ্ঠী হয় যদি তাতে একজন যোগ দেয় বা সদস্যপদ ত্যাগ করে সম্পূর্ণ তার নিজের ইচ্ছায়, ওই গোষ্ঠীর সদস্যপদ গ্রহণ করার সময় সে জানে সে কী করতে চলেছে, আর জানে ওই গোষ্ঠীর লক্ষ্য কী, এবং ওই লক্ষ্যে পৌঁছতে তার নিজের চেষ্টার সীমা কতদূরে।

 

এখন বলাই বাহুল্য, জাত হল একটি অত্যন্ত খাঁটি সংগঠিত সামাজিক সংগঠন। এটা কোনও নড়বড়ে বা ভাসমান সংগঠন নয়। একইভাবে এটাও বলাই বাহুল্য যে, জাত হল এক অনৈচ্ছিক সংগঠন। একজন হিন্দু তার জাতের ভিতরে জন্মগ্রহণ করে, জাতের সদস্য হয়ে জাতের ভিতরেই মরে। একজন হিন্দুও নেই যে জাতহীন, যে জাতের হাত ফস্কে পালিয়ে যেতে পারে। সে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জাতের জাঁতাকলে পেষাই হতে হতে সামাজিক নিয়মকানুনের আর ঐতিহ্যের পায়ে সেলাম ঠুকে চলেছে, কেননা জাতের কঠোর বেড়াজাল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

 

প্রত্যেকটি জাতের একটা আলাদা নামের, নামকরণের তাৎপর্য হল – এই ব্যবস্থাটি জাতগুলোকে করে তোলে এক একটি সংগঠিত অনৈচ্ছিক গোষ্ঠী। জাতের একটা আলাদা ও নিজস্ব নাম জাতকে পরিণত করে স্বার্থগোষ্ঠীতে, একে দান করে  চিরযৌবন এবং লাগিয়ে দেয় একান্ত  নিজস্বতার সীলমোহর। জাত নিয়ে লেখালেখি করা বিদ্বানদের মধ্যে প্রতিটি জাতের একটা করে আলাদা আলাদা নামের তাৎপর্য সঠিকভাবে বোধগম্য হয়ে ওঠেনি। তার ফলে তাঁরা জাতপাতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যটাকেই ঠাহর করে উঠতে  পারেননি। সামাজিক সংগঠন হয় , সব সমাজেই সামাজিক সংগঠন আছে। বহু দেশের বহু সামাজিক সংগঠনকেই ভারতের জাতগুলোর সঙ্গে সমান করে দেখা যেতে পারে, এবং বিবেচনা করা যেতে পারে ভারতীয় জাতগুলোর বিদেশি সংস্করণ হিসেবে। যেমন সামাজিক সংগঠন হিসেবে কুমোর, ধোপা, বিদ্বান ইত্যাদির সংগঠন সব দেশেই বিদ্যমান। কিন্তু অন্যান্য দেশে সেগুলো আছে অসংগঠিত ও ঐচ্ছিক সংগঠন হিসেবে,অথচ ভারতের ক্ষেত্রে সেগুলো তৈরি করেছে জাতের খাঁচা, কারণ অন্যান্য দেশে তারা সামাজিক সংগঠনগুলোর বিশেষ নামকরণ করেনি, যা করেছে ভারত। নামটাকেই আঁকড়ে ধরে টিঁকে থাকে জাত, নামই জাতকে দেয় তার স্থায়িত্ব, প্রবহমানতা আর নিজস্বতা। নামই একজন ব্যক্তির জাতপরিচয়কে সংজ্ঞায়িত করে। অনেক ক্ষেত্রেই একজন ব্যক্তিকে তার জাতপরিচয়কে নামের শেষে পদবী করে জুড়ে নিয়ে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। আবার নামই জাতের ধ্বজাধারীদের জন্য জাতের নিয়মকানুন বলবৎ করার সুবিধা করে দেয়। সুবিধা করে দেয় দু’ভাবে। প্রথমত, জাতনাম পদবী করে নামের শেষে জুড়ে থাকা ব্যক্তিদের পক্ষে জাতের নিয়ম ভঙ্গ করে নিজের জাত থেকে পালিয়ে অন্য জাতে আশ্রয় নেওয়ার আর জাত পঞ্চায়েতিরর থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় থাকে না। দ্বিতীয়ত, ওই নাম ধরেই তাকে খুঁজে বের করা যায়, এবং কেউ কোনও জাত-নিয়ম ভঙ্গ করে ফেললে, যে  জাতের বিচারধারায় তার অবস্থান, সেই জাতের হাতে খুব সহজেই তাকে প্রত্যর্পণ করা যায়।

 

এই হল জাত। জাত বলতে যা বোঝায়। আর জাত ব্যবস্থা কী? জাত ব্যবস্থা হল নানা ধরনের জাতগুলোর ভিতরকার পারস্পরিক সম্পর্ক। জাত ব্যবস্থাকে বুঝতে হবে পরস্পর-সম্পৃক্ত অনেকগুলো জাতের গুচ্ছ হিসেবে। আর সেভাবে দেখলে তবেই অনেকগুলো চমক জাগানো বৈশিষ্ট্য নজর করা যাবে। প্রাথমিক ভাবে নানা রকমের জাতগুলোর মধ্যে কিন্তু কোনও আন্তঃসম্পর্ক নেই যা কিনা একটা পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থায় থাকা দরকার। প্রতিটি জাত আলাদা আর স্বয়ম্ভর। প্রতিটি জাত নিজ নিজ জাতের আভ্যন্তরীণ কর্মকান্ডে বা জাতের নিয়মাবলী বলবৎকরণে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম। জাতগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে আছে, কিন্তু কেউ কারোর ভিতরে সেঁধিয়ে যায়নি। এ হল একটা আনুভূমিক বিভাজন। দ্বিতীয় ব্যাপার হল, জাতগুলোর মধ্যেকার পারস্পরিক সজ্জা, যেখানে এক একটি জাত অন্য অন্য জাতের সাপেক্ষে এক একটা নির্দিষ্ট অবস্থান নিয়ে আছে বা এক একটা থাক অধিকার করে আছে। সেই অবস্থান বা থাকগুলো উল্লম্বভাবে সাজানো। খাড়াখাড়ি একের উপরে এক, তার উপরে আর এক – এভাবেই একটা পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা খাড়া করেছে।

 

এই হল জাত, আর জাতের উপর জাত সাজিয়ে এই হল জাত ব্যবস্থা।

শিরোনামকরণ অনুবাদকের

 

Share this
Leave a Comment