সারাদিনের পর বাড়ি ফেরা। ক্লান্ত মন, শ্রান্ত শরীর। ঢিলেঢালা চোখে তাকিয়েছিলাম বাসের জানালা দিয়ে। হঠাৎই সমস্ত স্নায়ু টানটান হয়ে উঠল। ফুটপাথের রেলিঙে ছোট ছোট বোর্ডে বাংলায় ছাপা ‘স্বাগত বিক্রমাব্দ ২০৭৫’। আশেপাশে ভাগোয়াধ্বজ। রামননবমী পালনের আবেদনও ছিল। এলাকাটি উত্তরের পূর্বপ্রান্তে। লিখেছেন দেবাশিস আইচ।
অল্প অল্প মনে পড়ল প্রায় বছর খানেক আগের সংবাদপত্রের একটি রিপোর্টের কথা। রামনবমী, যুগাব্দ, বিক্রমসংবৎ, হিন্দু নববর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে বাঙালির হিন্দুসত্ত্বাকে চাগিয়ে তুলতে চাইছে সঙ্ঘ পরিবার। শুধুমাত্র, অস্ত্র উঁচিয়ে বাইক বাহিনীর রামনবমী পালন নয়। শুধু দাঙ্গা বাঁধিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে চরম বিভেদ সৃষ্টিই একমাত্র পথ নয় হিন্দুত্ববাদীদের। বাঙালির সাংস্কৃতিক মননকেও গ্রাস করতে চাইছে। ঘুণপোকার মতো তা যে কোথায় কতদূর বিস্তার করেছে, কতটা ফোঁপরা করেছে তলে তলে, তার ঠাহর পাওয়া মুশকিল। তবে, তা প্রকট হয়ে ওঠে যখন দেখতে পাই বিজেপি এ রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠছে। তার নানাবিধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে বটে, তবে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক কারণটিও কিছু কম নয়।
তো জানা যাচ্ছে, মূলত সঙ্ঘের উদ্যোগে বিগত চার-পাঁচ বছর ‘যুগাব্দ’ ও ‘বিক্রম সংবৎ’ পালিত হচ্ছে। চৈত্র মাসের শুক্ল প্রতিপদকেই ধরে নেওয়া হয় দুই কালগণনার প্রথম দিন অর্থাৎ নববর্ষ। গীতা রচনার সময়কাল থেকে যুগাব্দের শুরু। আর বিক্রমাদিত্যের অভিষেকের সময় থেকে শুরু বিক্রমাব্দের। আরও জানা যাচ্ছে, সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবতের আপ্ত সহায়ক এ রাজ্যে সঙ্ঘের বিশেষ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিক্রম সংবৎ পালনের উপর জোর দেন। তাঁর বক্তব্য, ‘আমরা গত ৪-৫ বছর ধরেই বাংলায় এটি পালন করার চেষ্টা করছি। তবে এ বছর থেকে বাঙালিদের মধ্যে এই উৎসবগুলির গ্রহণযোগ্যতা এবং আগ্রহ বেড়েছে। এটি বাঙালির নবজাগরণ হিসাবেই মনে করছি আমরা।’ (এই সময়, ২৯ মার্চ ২০১৭)।
বাঙালির সঙ্গে, বাংলার সঙ্গে বিক্রমাব্দের কোনও সম্পর্ক কস্মিনকালেও ছিল না। আমাদের দেশে এমন কত সংবৎই না প্রচলিত ছিল। ভারতে ইংরেজ আসার আগে প্রায় ২৩টি সংবৎ বা সন প্রচলিত ছিল। ইসলামি সভ্যতা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সংবৎ, অব্দের পাশাপাশি আরবি সন শব্দটি চালু হয়। যেমন, সপ্তর্ষি সংবৎ, বুদ্ধ নির্বাণ সংবৎ, মৌর্য সংবৎ, চালুক্য-বিক্রম সংবৎ, নেওয়ারি সংবৎ আবার ফসলি সন, বাংলা সন, এলাহি সন। এগুলি সবই বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় অথবা রাজা-মহারাজ-বাদশাহদের ঘোষিত সংবৎ বা সন।
মোঘল আমলে বাদশাহদের ধর্ম অনুসারে চালু হল হিজরি সন। অন্যদিকে মোঘল সাম্রাজ্য জুড়ে তখন প্রধান প্রধান জাতি-গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ক্যালেন্ডার। সংবৎ বা বছর গণনার হিসেব। হিজরির সঙ্গে তা মেলে না। অন্য অঞ্চল তো বটেই বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ সেখানে মিশ খায় না। ইসলামি মতে, বছরের যে কোনওদিনই পবিত্র। কেন না সবই আল্লার দিন। কিন্তু, তৎকালীন প্রায় কোনও প্রজারই এমন ধারার হিসেবে যে চলে না। আমরা জানি বারো চান্দ্র মাসের সমন্বয়ে গঠিত হিজরি ক্যালেন্ডার। চাঁদ পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করতে ২৯.৫৩ দিন সময় নেয়। এই সময়টি হল এক চন্দ্রমাস। তাহলে এক হিজরি সন বা ১২ চান্দ্রমাস হচ্ছে ৩৫৪.৩৬ দিন। এই চান্দ্রবর্ষ পঞ্জিকায় সূর্যের গতি বা অবস্থানের কোনও যোগ নেই। আবার সূর্য নির্ভর বা সূর্যের প্রেক্ষিতে পৃথিবীর অবস্থান অনুযায়ী যে দিনপঞ্জিকা যাকে আমরা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বলি তার হিসেব আবার অন্য। পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগে ৩৬৫.২৫ দিন। অর্থাৎ, এক সূর্যবর্ষ। বাকি রইল ০.২৫ দিন। নানা অঙ্ক কষে স্থির হল চার বছর পর পর এক দিন (০.২৫ x ৪ = ১) ফেব্রুয়ারি মাসে যোগ করা হবে।
এতো গেল হিজরি আর আমরাও যে ইংরেজি অর্থাৎ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি তার কথা। এবার বাংলা সনের কথায় আসি। বাদশাহ জালালউদ্দিন মহম্মদ আকবর লক্ষ করলেন হিজরি শাসন অনুযায়ী দেশ শাসন চলে না। ঋতু মেলে না, ফসল ফলনের সময় মেলে না ফলত রাজস্ব আদায়, শুল্ক আদায়ে বেজায় গোলমাল বাঁধে। এমন সংকটে ডাক পড়ল মোঘল দরবারের রাজ জ্যোতির্বিদ আমির ফতেউল্লাহ শিরাজির। রাজ জ্যোর্তিবিদ নানা জটিল অঙ্ক কষে চান্দ্রমাস নির্ভর হিজরি বর্ষপঞ্জি এবং প্রাচীন হিন্দু জ্যোতিষ শাস্ত্র সূর্যসিদ্ধান্ত ঘেঁটে নতুন ফসলি বর্ষপঞ্জি প্রস্তুত করেন।
আমরা জানি আকবর ভারতের নানা ধর্মের প্রতি আগ্রহ থেকে এক সমন্বয়ী ও সমান্তরাল ধর্ম দীন-ই-ইলাহি প্রবর্তন করেন। অমর্ত্য সেনের মতে, সেই একই ট্র্যাডিশন অনুযায়ী তাঁর আমলে প্রবর্তিত হয় নয়া ক্যালেন্ডার তারিখ-ই-ইলাহি বা আল্লাহর দিনপঞ্জি। (দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান।) অন্যান্য অনেক ঐতিহাসিক অবশ্য মনে করেন, এই দিনপঞ্জি প্রবর্তন করার পিছনে আকবরকে ধর্ম বা ধর্মীয় তন্ত্রের চেয়ে ঢের বেশি প্রভাবান্বিত করেছিল অন্য আরও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন চাহিদা। আর সেটি হল: কর আদায়। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব। (কুণাল চক্রবর্তী ও শুভ্রা চক্রবর্তী, হিস্টরিক্যাল ডিকশনারি অব বেঙ্গলিজ।)
তা, শিরাজির চান্দ্র-সৌর সমন্বয়ী সনের হিসাবটি সরল করে বলা যাক। প্রথমে আকবরের অভিষেকের বছরটিকে অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দকে হিজরি সনে রূপান্তরিত করা হল। এই হিজরি সনটি হল ৯৬৩। অর্থাৎ ১ নয় বছর শুরু হল ৯৬৩ হিজরি সনে। এর পর তিনি সূর্যসিদ্ধান্ত অনুযায়ী সৌর বছরের গণনায় এলেন। ফরমুলাটা এরকম, আকবরের অভিষেকের ইসলামি বছর (৯৬৩) + বর্তমান সৌর বছর (২০১৮) – আকবরের অভিষেকের সৌর বছর (১৫৫৬) = ১৪২৫। বা বর্তমান নববর্ষ। ভারতে পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরায় এবং বাংলাদেশে এই বঙ্গাব্দের প্রচলন রয়েছে। অসমে এই ক্যালেন্ডার চালু করেন রাজা ভাস্কর বর্মন। বাংলাদেশে অবশ্য পয়লা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল এবং আমাদের একদিন পর ১৫ এপ্রিল। কেন? সে অন্য আর এক ফিরিস্তি।
এবার একটু হিজরি বা ইসলামি বর্ষের কথা বলি। আমরা আগেই বলেছি নানা সংবৎ, সাল, অব্দ, রাজা-বাদশাদের অভিষেক বা যুদ্ধজয়ের মতো ঘটনাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। হিজরি বা ইসলামি বর্ষ বা অব্দ হজরত মহম্মদের মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গমনের দিন থেকে শুরু। বোঝাই যাচ্ছে এই হিজরি শব্দটি এসেছে হিজরত থেকে। যার অর্থ ধর্মরক্ষা ও প্রচারের জন্য দেশত্যাগ। হজরত মহম্মদ ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে শুরু করলে তৎকালীন মক্কাবাসীদের কাছ থেকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। তারা তাদের প্রাচীন ধর্ম রক্ষা করার জন্য মহম্মদের উপর নানা অত্যাচার শুরু করে। তাঁর প্রাণসংশয় দেখা দিলে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে সপরিবার ও সদলে মক্কা ত্যাগ করেন এবং মদিনায় আশ্রয় নেন। এই যাত্রাকেই বলে হিজরত।
নয়া দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে (দ্য আসেসমেন্ট অব দ্য মিলেননিয়াম, ২০ আগস্ট ১৯৯৮) বক্তব্য রাখতে গিয়ে অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, ‘একজন বাঙালি হিন্দু যখন বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করছেন, তিনি বোধহয় তখন পুরোপুরি জানেনও না যে, হিন্দু আচার অনুশীলনের প্রার্থিত ওই তারিখটির সঙ্গে মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার স্মৃতি একই তারে বাঁধা আছে। যদিও তা এক চান্দ্র-সৌর মিশ্রিত প্রতিরূপ।”
সেকুলার হিন্দু যে কত মাত্রার আত্মবিধ্বংসী হয়ে থাকে এ,এই লেখক তার প্রমাণ।