অসমের প্রতিক্রিয়া এবং বিগত প্রায় এক বছর ব্যাপী বিজেপি’র কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের লাগাতার হুমকির ফলে রাজ্যে নাগরিক পঞ্জি নিয়ে আতঙ্ক ভয়াবহ আকার নিয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর এই ১০ দিনে এনআরসি বা নথি আতঙ্কে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
রাজ্যে নাগরিক পঞ্জি নিয়ে আতঙ্ক ভয়াবহ আকার নিয়েছে। এমনকী ভোটার তালিকায় নাম সংযোজন, সংশোধন কিংবা যাচাই করে নেওয়া কিংবা ডিজিটাল রেশন কার্ড তৈরি ও সংশোধনের মতো রুটিন কাজে মানুষ প্রবল উদ্বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। শুধু জেলার বিডিও অফিস নয়, জন্মের শংসাপত্র জোগাড় করতে একই ছবি দেখা যাচ্ছে কলকাতা পুরসভাতেও। এসবই হচ্ছে নাগরিক পঞ্জি নিয়ে আতঙ্কে এবং অসমের প্রতিক্রিয়া এবং বিগত প্রায় এক বছর ব্যাপী বিজেপি’র কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের লাগাতার হুমকির ফলে। এ অভিযোগ মৃতের পরিবারেরই।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর এই ১০ দিনে এনআরসি বা নথি আতঙ্কে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এঁদের মধ্যে আত্মঘাতী হয়েছেন আট জন। বাকিরা উদ্বেগে, দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে কিংবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়েও মারা গিয়েছেন কেউ কেউ। মৃতদের মধ্যে ১৩ জন মুসলিম সম্প্রদায়ের। হিন্দুদের মধ্যে তিনজন উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ। এঁদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা পাঁচ। উত্তরবঙ্গে মৃতের সংখ্যা আট, দক্ষিণবঙ্গে ন’জন। মৃতেরা প্রায় সকলেই দরিদ্র শ্রমজীবী বা কৃষিজীবী। সংবাদপত্রের বিবরণ অনুযায়ী প্রথম মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে ১৭ সেপ্টেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলায়। নীচে মৃত্যুর কারণ-সহ মৃতদের নাম, পরিচয় দেওয়া হল।
(১) মিলন মণ্ডল (২৭) ।
স্ত্রীর শাড়ি দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মঘাতী। ১৭.০৯.১৯।
জেলা – মুর্শিদাবাদ, ডোমকল, গ্রাম শিবনগর।
ভোটার ও আধার কার্ডে নামের বানানে অসঙ্গতি। ১৭ দিন ধরে সংশোধনের চেষ্টা ব্যর্থ। বাবা দিস্তার মণ্ডলের দাবি, নথিতে ভুল থাকায় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল। বার বার অভিযোগ করছিল নাগরিক পঞ্জি হলে ভিটেমাটি হারাতে হবে। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য জুলেখা বিবি জানান, শুধু মিলন নয় গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এনআরসি আতঙ্কে ভুগছেন।
আতিকুর রহমান, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ভগীরথ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। “নাগরিক পঞ্জি নিয়ে মানুষের মনে ভয়াবহ আতঙ্কের তৈরি হয়েছে। এই যুবকও হয়তো তীব্র আংজাইটি ডিসঅর্ডারে ভুগছিলেন।”
পেশা – পরিযায়ী শ্রমিক।
(২) অন্নদা রায় (৩৯)
বাড়ির কাছেই রেলগেটে গামছা দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মঘাতী। ২০.০৯.১৯।
জেলা – জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি ব্লকের মাধবডাঙা ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের বড়কামাত এলাকায় বাড়ি।
অসমে নাগরিক পঞ্জি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ৩১ অগস্ট তালিকা প্রকাশের উদ্বেগ বাড়ে। নিজের চার বিঘা জমি রয়েছে। কিন্তু তা বন্ধক দেওয়ায় জমির দলিল তাঁর কাছে ছিল না। বাস্তুজমি নিয়েও সমস্যা ছিল বলে খবর। দলিলের অভাবে বিপদে পড়ার আশঙ্কায় আত্মঘাতী হন বলে পরিবারের দাবি।
পেশা – চাষি।
(৩) মন্টু সরকার (৫২)
নথি পরীক্ষা করতে বালুরঘাট বিডিও অফিসে হাজার খানেক মানুষের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানেই অসুস্থ হয়ে মারা যান। ২০.০৯.১৯।
জেলা – দক্ষিণ দিনাজপুর, বালুরঘাট।
পরিবারের দাবি নাগরিক পঞ্জি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। ৩১ অগস্টের পর থেকে তা আরও বাড়ে।
(৪) সোলেমান সরকার (৫৫)
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। ২০.০৯.১৯।
উত্তর দিনাজপুর। ইটাহার।
১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন। পঞ্জি আতঙ্ক তাঁকে গ্রাস করেছিল বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
(৫) আমেনা বেওয়া (৫৫)।
অতিরিক্ত দৌড়ঝাঁপ ও উদ্বেগে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু। ২০.০৯.১৯।
উত্তর ২৪ পরগনা, হিঙ্গলগঞ্জ, কাটাখালি গ্রাম।
জমি-বাড়ির নথি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এর জন্য বাঁকুড়ায় বাপের বাড়ি অবধি দৌড়াতে হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় নথি উদ্ধার করতে না পেরে বাড়িতে এসে অসুস্থ হয়ে মারা যান।
বাড়িতে বিড়ি বেঁধে সংসার চালাতেন।
(৬) মন্টু মণ্ডল (৪০)
বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু।
উত্তর ২৪ পরগনা, বসিরহাট, মাটিয়া, দক্ষিণ কৃপালপুর। ২১.০৯.১৯।
আধার, ভোটার পরিচয় পত্রে নামের বানানে অসঙ্গতি ছিল। বিডিও অফিসে ডিজিটাল রেশন কার্ডের জন্য ছোটাছুটি করছিলেন। নাগরিক পঞ্জি নিয়ে আতঙ্কও ছিল।
(৭) আলিয়া বেওয়া (৫৫)।
নথির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু। ২১.০৯.১৯।
উত্তর ২৪ পরগনা, বসিরহাট, বাঁকড়া।
প্রবীণ আলিয়া বেওয়াকে ডিজিটাল রেশন কার্ডের জন্য দীর্ঘক্ষণ হিঙ্গলগঞ্জের বিডিও অফিসে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেখানেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যু হয়।
(৮) আয়ুপ আলি (৫৫)
নথি-আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু। ২১.০৯.১৯।
উত্তর ২৪ পরগনা, বারাসত, শাসন, চক আমিনপুর।
ভোটার পরিচয়পত্র এবং ডিজিটাল রেশন কার্ডের জন্য দিন দশেক ধরে ছোটাছুটি করছিলেন। আবার লোকের কথায় ‘৭১ সালের আগের দলিলেরও খোঁজ চালাচ্ছিলেন। তাঁর এপিকে বাংলায় আয়ুপ আলি লেখা থাকলেও ইংরেজিতে আয়েপ আলি রয়েছে। নথির চিন্তায় খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে পরিবারের অভিযোগ। এর পর হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২১ সেপ্টেম্বর বারাসত জেলা হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
(৯) কামাল হোসেন মণ্ডল (৩৫)।
আত্মঘাতী। আমবাগানে ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার। ২২.০৯.১৯।
উত্তর ২৪ পরগনা, বসিরহাট, সোলাদানা বাজার।
ভোটার কার্ড, আধার কার্ডে নামের বানানে অসঙ্গতি ছিল। ডিজিটাল রেশন কার্ডের পিছনেও দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। জমির দলিলের জন্যও মাথাব্যথা ছিল। পরিবারের দাবি পঞ্জি-আতঙ্কের জন্য দিশেহারা হয়ে আত্মহত্যা করেন।
পেশা – ইটভাটার শ্রমিক।
(১০) কালাচাঁদ মিদ্যা (৪২)।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ফলতা, মামুদপুর। ২২.০৯.১৯।
ডিজিটাল রেশন কার্ড তৈরি এবং নতুন নিয়মে ভোটার তালিকায় নাম তোলা নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। পরিবারের দাবি পঞ্জি-আতঙ্ক আর নথি সংগ্রহে ব্যতিবস্ত হয়েই আত্মঘাতী হন। ২১ সেপ্টেম্বর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। ২২ সেপ্টেম্বর বাড়ির কাছে বাঁশবাগানে তাঁর ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
পেশা – জরি কারখানার শ্রমিক।
(১১) শ্যামল রায় (৩২)।
আত্মঘাতী। বাড়িতে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার। ২৪.০৯.১৯।
জলপাইগুড়ি, ধূপগুড়ি, বর্মণপাড়া।
ভোটার কার্ড হারিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আধার ও রেশন কার্ড নিয়েও সমস্যা ছিল। ভবিষ্যতে নাগরিক পঞ্জিতে নাম বাদ পড়ার ভয়ে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন।
পেশা – ভ্যানচালক।
(১২) আর্জিনা খাতুন (২৭)।
আত্মঘাতী। বাড়িতে গলায় দড়ি দেন। ২৪.০৯.১৯।
কোচবিহার, ঘুঘুমারি, হাউয়ারগাড়ি গ্রাম।
এপিকে তিনি ছিলেন আর্জিনা খাতুন। আধারে হয়ে গিয়েছিলেন আর্জিনা খাতুন বিবি। আবার স্বামীর আধারের নাম আনোয়ার হোসেন অন্যদিকে এপিকে নাম আনোয়ার মিয়া। অসম লাগোয়া কোচবিহারের বাসিন্দারা জানেন নামের এই অসঙ্গতির কারণে সে রাজ্যের মানুষকে কী মূল্য দিতে হয়েছে। নাম সংশোধনের জন্য চেষ্টাও চালাচ্ছিলেন। এক সময় হতাশ হয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন বলে তাঁর স্বামীর অভিযোগ।
পেশা – গৃহবধূ।
(১৩) সাবের আলি (৩২)।
কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী। ২৪.০৯.১৯।
জলপাইগুড়ি, কোতোয়ালি থানার বাহাদুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সরদার পাড়া।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, দুই মেয়ের জন্মের শংসাপত্র এবং আধার কার্ডে নামে হেরফের ধরা পড়ে। এছাড়াও বাড়িতে পুরনো নথিও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত প্রচণ্ড উদ্বেগ সামলাতে না-পেরে আত্মহত্যা করেন।
পেশা – চাষি।
(১৪) সামসুল হক (৪৪)।
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। ২৪.০৯.১৯।
কোচবিহার, দিনহাটা।
নথি জোগাড়ের জন্য কিছুদিন ধরেই পরিশ্রম করছিলেন। সম্ভাব্য সমস্ত নথি না-থাকলে নাগরিক পঞ্জি হলে বিপদে পড়তে পারেন বলে মানসিক অবসাদেও ভুগছিলেন।
(১৫) তসলিমা বিবি (৪৮)।
নথি নিয়ে উদ্বেগে স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যু। ২৫.০৯.১৯।
উত্তর ২৪ পরগনা, হিঙ্গলগঞ্জ, কাটাখালি গ্রাম।
তসলিমা বিবি ও তাঁর স্বামী আকবর আলি রুজিরোজগারের জন্য তামিলনাডে থাকেন। প্রবাসে থাকার জন্য আধার কার্ড করাতে পারেননি। সম্প্রতি বাড়ি ফিরে শোনেন আধার কার্ডের সঙ্গে ভোটার কার্ড নাকি লিংক করতে হবে। এছাড়াও সামান্য বাস্তুজমিরও নথি সমস্যা রয়েছে। কী থেকে কী করবেন এই নিয়ে স্বামীর সঙ্গে উত্তেজিত কথাবার্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বসিরহাট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তিনি মারা যান।
পেশা – পরিযায়ী শ্রমিক।
(১৬) মায়া বর্মন (৮০)
আত্মঘাতী। বাড়িতে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার। ২৫.০৯.১৯।
কোচবিহার, দিনহাটা ২ ব্লক, বড়শাকদল পঞ্চায়েত, ঘাটপাড় এলাকা।
ছেলে মনোরঞ্জন বর্মন সাংবাদিকদের জানান, এনআরসি আতঙ্কে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। কাগজপত্র নিয়েও সমস্যা ছিল। সমাধান করতে না-পারার ফলেই আত্মহত্যা করে বসেন।
(১৭) গিয়াসুদ্দিন শেখ (৬০)
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। ২৬.০৯.১৯।
মুর্শিদাবাদ, হরিহরপাড়ার রাইপুর অঞ্চলের সলুয়া গ্রাম।
এনআরসি আতঙ্কই তাঁর মৃত্যুর কারণ বলে পরিবারের দাবি। তাঁর এক আত্মীয় জানান, রাজ্যে নাগরিক পঞ্জি হবে জেনে তিনি কিছু নথি জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কোনো কোনো নথি না-মেলায় চিন্তায় চিন্তায় দু’দিন ধরে বাড়ির কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন না। হঠাৎই বুকে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে বলে তিনি জানান। মুর্শিদাবাদ জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও তিনি মারা যান।
সূত্রঃ বিভিন্ন তারিখের আনন্দবাজার, এই সময়, গণশক্তি, দ্য টেলিগ্রাফ, টাইমস অব ইন্ডিয়া‘র প্রিন্ট ও ওয়েব সংস্করণ এবং এবিপি আনন্দ টেলিভিশনের খবর।
সংকলকঃ দেবাশিস আইচ।