লাগাতার অনশনে গুরুতর অসুস্থ হবু ডাক্তাররা: ভ্রুক্ষেপ নেই সরকার ও মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের


  • July 17, 2018
  • (0 Comments)
  • 2200 Views

প্রিয়স্মিতা

কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কোলকাতা মেডিকাল কলেজএকদম সাম্প্রতিক কালে এই তিন জায়গায় ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন থেকেছে প্রায় সব খবরের কাগজের কোনো না কোনো পাতায়। হালফিলে এই তিন জায়গার আন্দোলনের সাথে সাথেই ঘটেছে/ঘটে চলেছে একাধিক ছাত্রছাত্রী আন্দোলন। কখনো মালদার গনি খান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেকখনো গড়িয়াহাটের বিড়লা আর্ট কলেজ – আন্দোলনের ঝলক দেখা যাচ্ছে নানান জায়গাতেই। কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে উত্তর চাইতে গেলে জানা যাচ্ছে তাদের হাত পা বাঁধাবিশেষ কিছুই করার নেই। UGC-কেই তুলে দেওয়াপ্রবেশিকা পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়াও একই সময়ে একই সাথে বিলিওনেয়ার ব্যবসাদারের ভুয়ো কাগুজে ইউনিভার্সিটি‘-কে দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ‘ ঘোষণা করে কোটি কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যবসাদারের পকেটে গুঁজে দেওয়া – আঘাত এখন নামছে অনেক উপর থেকে। সরাসরি শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরঅথবা MHRD, অথবা নবান্ন থেকে। সাম্প্রতিক যাদবপুর বা মেডিকালের আন্দোলনএর মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে শিক্ষাক্ষেত্রে এই ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রশ্ন – যে কাঠামোগত পরিবর্তন এতদিন সবার চোখের আড়ালে একটু একটু করেএবং সাম্প্রতিককালে সম্পূর্ণ নগ্নভাবেভারতের স্বাধীন চিন্তার আঁতুড়ঘর বলে পরিচিতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হয়ে চলেছে।

হোস্টেল-এর দাবীতে আন্দোলন মেডিকেল কলেজে

কলেজে কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন গুলিতে শাসকদলের পেটোয়া দালাল ছাত্রসংগঠন ও তাদের আন্দোলনবিমুখতা — এ চিত্র আমাদের বড়োই পরিচিত। এবং বিপরীত চিত্রটি বড়োই দুর্বল। প্রেসিডেন্সিযাদবপুরমেডিক্যাল কলেজ বা দিল্লির জেএনইউএর মতো কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজো যে টিকে আছে শাসকদলগুলির ধামাধরা ছাত্রসংগঠনের বাইরে ও বিপরীতে টিকে থাকা যে কয়েকটি স্বাধীন ছাত্রসংগঠনবর্তমান ভারতবর্ষে তারাই আমাদের কিছুটা আশার আলো দেখায়। সাম্প্রতিক ইতিহাসে সেইসব স্বাধীন ছাত্রসংগঠনগুলির হাত ধরেই আমরা দেখেছি বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ আন্দোলন। তোএহেন অবস্থায়যখন স্তিমিত হয়ে আসছে এ দেশের প্রায় সব প্রতিবাদের ক্ষেত্রযেকোনো ধরনের সমালোচনা ও প্রতিবাদী সংস্কৃতির অনুগামী হয়ে মাত্রই শিকার হতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় রোষের,সেখানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেও আমরা দেখলাম একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি।

গুরুতর অবস্থায় মেডিকেল কলেজের অনশনকারী ছাত্র অনিকেত

রাষ্ট্র এই নয়াউদারবাদের সংকটের সময়ে যেনতেন প্রকারেণ সেই জায়গাগুলোর উপর আঘাত আরও জোরালো করতে চাইছে। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় কমিটি‘ গঠন করে ডিপার্টমেন্টগুলোর হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে। যাদবপুরে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের Board of Studies এর হাতে ক্ষমতা প্রায় শূন্য করে দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য এর পেছনে আগের সরকারে যে দল ছিল তাদের ভূমিকা ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করে দিয়ে গিয়েছে। তারা বিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে সরকারে থাকার সুবিধেবাদ দিয়ে এমন লুকোনো একটি ব্যাপার বানিয়েছিলেনযে আজ সমস্ত অধিকারের কেন্দ্রীভবন অনেকাংশে মানুষের কাছে তুলনামূলক স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। ঠিক যেভাবে আজকে কেন্দ্রীয় সরকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে দেশের ফেডারাল কাঠামোগুলিকে প্রায় নিশ্চিনহ করে দিতে বসেছে। মেডিকাল কলেজেও ছাত্রদের হোস্টেল অ্যালটমেন্ট বন্ধ করে একাধারে নামমাত্র খরচে থেকে পড়াশুনো করার অধিকারের উপরেই আঘাত নামানো হচ্ছেআরেকদিকে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ছাত্রছাত্রী সংগঠনকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সেইসব সংগঠন ও আন্দোলনযারা গ্রাম মফঃস্বল থেকে ডাক্তারি পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের সমাজে অন্যরকম কিছু করে দেখানোর স্বপ্ন দেখার জায়গা তৈরির কাজ করেযারা ইতিহাস থেকে বাজারের হাতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা চলে যাওয়ার তীব্র বিরোধিতা করে আসছেবা একের পর এক আন্দোলনে স্বাস্থ্য শিবির সংগঠিত করার মত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। রাষ্ট্র বন্ধ করে দিতে চায় এ সবকিছুই। আর তার সুযোগ্য প্রশাসকের ভূমিকা নিচ্ছেন মমতা ব্যানার্জিনির্মল মাঝিউচ্ছল ভদ্রের মত লোকজন।

ধীরে ধীরে শিক্ষা স্বাস্থ্যের মত বেসিক অধিকারগুলিকে সম্পূর্ণভাবে ব্যবসার আওতায় নিয়ে আসাপ্রতিবাদের জায়গাগুলিকে চিরতরে নিশ্চিনহ করে দেওয়াএটা একটা প্ল্যানের মধ্যে পড়ে। যে প্ল্যানের অংশ হিসেবে চিরপরিচিত ক্যান্টিন হয়ে যায় সি.সি.ডি.-র ক্যাফেটেরিয়াযেখানে ৪০টাকায় কফি বিক্রির সাথে সাথে শিক্ষা বিক্রির ধারণাটাকেও সুপরিকল্পিত ভাবে গুলে খাইয়ে দেওয়া যায়। বন্ধ হয়ে যায় ক্যান্টিন‘ – যা পারতপক্ষে সমাজশিক্ষাআন্দোলনকলেজের ইতিহাস নিয়ে গল্পতর্কআড্ডার একটি পরিসর। ভিতর থেকে শুকিয়ে আসে ভাবতে পারারঅন্যরকমের স্বপ্ন দেখতে পারার স্পেসগুলো। তাই জে.এন.ইউ.-তে ন্যূনতম প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের উপর নেমে আসে ২০৩০ হাজার টাকার ফাইন। ইউ.জি.সি.-র মত প্রতিষ্ঠান তুলে দিয়ে শিক্ষায় বাজেটের বরাদ্দ কমানোকে গ্যারান্টি করা হয়।

‘অসুস্থ’ প্রিন্সিপাল

কোলকাতা মেডিকাল কলেজের চলতে থাকা আন্দোলন এসব কিছুর বিরোধিতার অংশ হিসেবেই জায়গা করে নেবে। এ লেখা লেখার সময় ১৬৯ ঘন্টায় পড়েছে হবু ডাক্তারদের অনশন, ‘পিতৃসম’ প্রিন্সিপাল বা কলেজ কর্তৃপক্ষ এখনও নির্বিকার। প্রিন্সিপাল ছাত্রছাত্রীদের নিজেই বলেছেন যে তিনি “তৃণমূলের”। ১৬ই জুলাই অভিভাবকরা এসে উত্তর চেয়েছেন প্রিন্সিপালের কাছে, ডেপুটেশন জমা দিয়ে বসেছেন প্রতীকী অনশনে। ১৬ই জুলাইতেই তৃণমূলের ডাক্তারি সংগঠন PDA ‘সরকারবিরোধী‘ ছাত্রদের বেয়াড়াপনার প্রতিবাদে মিছিল ডাকে। ১৭ই জুলাই ছাত্রছাত্রীদের সমর্থনে শহরের কিছু সিনিয়র ডাক্তার ১২ঘন্টার প্রতীকী অনশনে বসেন। যদিও প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকা অনশনে এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা প্রতিষ্ঠিত নামীদামি ডাক্তারদের প্রায় কাউকেই একদিনের জন্যও ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। অনশনকারী সিনিয়র ডাক্তারদের একটা দল প্রিন্সিপালের সাথে ফর্মালি কথা বলতে গেলে তিনি অসহযোগিতা করেন। 

এরপর ছাত্রদের জন্য নতুন হোস্টেলে ঘর বরাদ্দ করে তার একটা তালিকা প্রকাশ করা হয়। এই তালিকা তৈরিতে প্রিন্সিপালকে সহায়তা করতে তার চেম্বারে হাজির ছিলেন তৃণমূল ছাত্রপরিষদের গুন্ডা নেতারা।  স্বাভাবিকভাবেই এই তালিকা সাধারণ ছাত্ররা মেনে নেয়নি। এরপরই হঠাৎ করে প্রিন্সিপালের বুকের ব্যাথা শুরু হয় এবং মেডিক্যাল কলেজের আরেক হর্তাকর্তা এবং শাসকদলের ঘনিষ্ঠ ডাক্তার রাজা ভট্টাচার্য-এর পরামর্শ অনুযায়ী হুইলচেয়ারে করে নিয়ে গিয়ে আইসিইউতে ভর্তি করা হয় প্রিন্সিপ্যালকে, ‘শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতির কারণে’। পরে অবশ্য জানা যায় ইসিজি রিপোর্ট নরম্যাল। কোনো রকম সমস্যা নেই। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার নাটক জারি রাখতে এরপর নিজের হাসপাতাল ছেড়ে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হন তিনি। অদম্য জেদ আর মনোবল সঙ্গে করে, প্রায় ২০০ ঘন্টা হতে চলল না খেয়ে, ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বসে আছে কতগুলো অসম সাহসী তরুণ আর তাদের সাথে অতন্দ্র পাহারায় রয়েছে হার না মানা মুখের দল। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের এই আন্দোলন শেষ দেখে ছাড়বে।

প্রিয়স্মিতা ছাত্রছাত্রী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। সমস্ত ছবি আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের তোলা।

Share this
Leave a Comment