আসিফা বানো। বয়স ৮। আসিফাকে ৬ জন মিলে ধর্ষণ করলো। ৮ দিন ধরে। আসিফার বাড়ি কাঠুয়া। কাঠুয়া জম্মু–কাশ্মীরে। কাশ্মীর মানে আর্মি–র স্পেশাল ক্ষমতা। কাশ্মীর মানে সাধারণ মানুষের উপর সরকারি ছররা গুলি। প্রায় প্রতিটা বাড়িতে একজন করে নিখোঁজ, অথবা অত্যাচারিত, অথবা মৃত। ৮ বছরের শিশুকে মন্দিরের চাতালে গণধর্ষণকারীদের শাস্তির দাবী তোলার পরিবর্তে হিন্দু একটা মঞ্চের (যার মধ্যে বিজেপি–কংগ্রেস–পিডিপি সব দলের লোক আছে) নেতারা ও তাদের দোসর আইনজীবীরা ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল করলো। কাঁধে তেরঙ্গা নিয়ে। “জয় শ্রী রাম“, “ভারত মাতা কি জয়” স্লোগান তুলে মিছিল করা হলো, ধর্ষণকারীদের মুক্তির দাবীতে। এ কোন দেশ, এ কোন গণতন্ত্র, এ কোন ধর্ম…
কাঠুয়া–র ঘটনা নিয়ে IAPL-এর রিপোর্ট–র বাংলা অনুবাদ।
১১ এপ্রিল ২০১৮
জম্মুর কাঠুয়া জেলার রাসনা গ্রামের ৮ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের মামলায়, গত সোমবার (৯ই এপ্রিল), কাঠুয়া বার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবীরা রাজ্য পুলিশের পক্ষ থেকে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অভিযোগপত্র দাখিল করতে বাধা দেয়। আইনজীবীরা সংগঠিতভাবে পুলিশের পথরোধ ক’রে অভিযুক্তকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা থেকে বিরত করতে পারার জন্য গর্ব অনুভব করছে। সেইদিনই কাঠুয়া বার এসোসিয়েশনের সভাপতি এইমর্মে একটি প্রস্তাব পাস করেন যে ১২ এপ্রিল অবধি আদালতের কাজ বন্ধ থাকবে। সাথে সাথে তারা ১১ এপ্রিল গোটা কাঠুয়া আর জম্মু ও কাশ্মীর জুড়ে বন্ধ পালন করার ডাকও দেয়।
পটভূমি
জানুয়ারি মাসে বাকরওয়াল–গুজ্জর (এবং মুসলিম) সম্প্রদায়ের একটি ৮ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ এবং হত্যা করা হয়। হত্যা করার আগে তাকে প্রায় এক সপ্তাহ মাদকাসক্ত করে একটি মন্দিরে আটক ক’রে রাখা হয়। বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাকরওয়াল সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটিকে অপহরণ ও ধর্ষণ করে। এই ঘটনার পরে এই সম্প্রদায় এবং এই পরিবারটিকে সামাজিকভাবে বহিষ্কৃত করা হয়, এমনকি শিশুটির পরিবারকে নিজেদের গ্রামে তাঁদের সন্তানকে কবর পর্যন্ত দিতে দেওয়া হয়নি। এর আগে, গত বছরের এপ্রিল মাসে গোরক্ষকেরা রিয়াসি জেলার বাকরওয়াল সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। ধর্ষণের মামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এই কুকর্মের পরিকল্পনাকারী সানজি রাম, তার ছেলে বিশালকুমার, জনৈক পুলিশ হেড কনস্টেবল, দুই বিশেষ পুলিশ কর্মকর্তা (SPO) এবং পুলিশের জনৈক সাব–ইন্সপেক্টরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কাঠুয়া বার অ্যাসোসিয়েশনের এই কর্মসূচি নেওয়া হয় গত ফেব্রুয়ারি মাসে “হিন্দু একতা মঞ্চ” আয়োজিত পদযাত্রার পদচিহ্নকে অনুসরণ ক‘রে। সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি জঘন্যতম পর্যায়ে পৌঁছয় যখন হালফিলে তৈরী হওয়া দক্ষিণপন্থী সংগঠন “হিন্দু একতা মঞ্চ“ (রাজ্য বিজেপি সচিব বিজয় শর্মা পরিচালিত) অভিযুক্ত দীপক খাজুরিয়ার মুক্তির দাবিতে ৩০০০–৪০০০ লোকের সমাবেশ সংগঠিত করে। হিন্দু একতা মঞ্চ অভিযুক্তের গ্রেফতারকে ‘জিহাদ‘ বলে ঘোষণা ক’রে এই গোটা ঘটনাটিকে একটি সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়। এই সমাবেশের অংশগ্রহণকারীরা ভারতীয় পতাকাও ব্যবহার করে।
একটি ক্রমবর্ধমান প্রবণতা
যদিও কিছু প্রাথমিক সূত্রের খবর অনুযায়ী জানা যাচ্ছে যে পুলিশকে অভিযোগপত্র জমা করতে বাধা দেওয়ার জন্য আইনজীবীদের বিরুদ্ধে এফ.আই.আর. দাখিল করা হয়েছে, কিন্তু এই অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়েটির ধর্ষণের মামলা থেকে হিন্দুত্ববাদীদের রক্ষা করার প্রচেষ্টাকে বিজেপি এবং আর.এস.এস.–এর সাম্প্রদায়িক প্রচারের পটভূমিতে দেখতে হবে। এই ঘটনার কিছুদিন আগেই একটি দক্ষিণপন্থী সংগঠনের কিছু সদস্য শম্ভুলাল রেগারের (যে ক্যামেরার সামনে একটি মুসলিম শ্রমিককে হত্যা করে) সমর্থনে উদয়পুর জেলা আদালত এবং সেশনস কোর্টে হামলা চালায়। হিন্দুত্ববাদী মানুষজন এখনও রেগারের ঘৃণ্য অপরাধকে বীরপূজা করে চলেছে। ২০১৬ সালে কানহাইয়া কুমার–কে শুনানির জন্য আদালতে পেশ করার সময় পাতিয়ালা হাউস আদালত প্রাঙ্গনে তাঁকে মারধর করা হয়েছিল। পরে জানা যায় যে অভিযুক্ত আইনজীবীরা তাঁকে ‘ভারত মাতা কি জয়‘ স্লোগানটি দিতে বাধ্য করছিল।
দক্ষিণপন্থী দলগুলির ‘আইনি এক্টিভিজম’–র বৃহত্তর কার্যপ্রণালীর পটভূমি তৈরি হয় “সনাতন সংস্থা“ এবং তাদের সহযোগী সংগঠন “হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি” (গ্রাউন্ডজিরোর মন্তব্য: উভয় সংগঠনই নরেন্দ্র দাভোলকার এবং গোবিন্দ পানসারে–র হত্যাকাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত) দ্বারা যৌথভাবে গোয়ায় আয়োজিত এক বার্ষিক সম্মেলন, “সর্বভারতীয় হিন্দু কনভেনশন“-এর প্রথম অধিবেশনে (২০১২)। এই অধিবেশনের আয়োজকেরা হিন্দু আইনজীবীদের আহবান জানায় যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় জেলবন্দি এবং বিচারাধীন অবস্থায় থাকা হিন্দুদের রক্ষা করতে হবে। জুন ২০১৭–এ কনভেনশনের ষষ্ঠ অধিবেশনে ১৩২টি হিন্দু সংগঠনের উপস্থিতিতে পুনর্বার এই দাবি তোলা হয়। এইসবের ফলস্বরূপ প্রাক্তন আর.এস.এস. সদস্য এবং অখিল ভারতীয় অধিবক্তা পরিষদ (আর.এস.এস.-এর আইনি সংগঠন) সদস্যদের নেতৃত্বে বেশ কিছু জাতীয়তাবাদী আইনী–অধিকার বিষয়ক সংগঠন গজিয়ে ওঠে।
এইসবের ভিত্তিতে আমাদের বক্তব্য:
- আইনজীবী সমাজের মধ্যে বিভেদমূলক বা সাম্প্রদায়িক এজেন্ডার ভিত্তিতে সাধারণ মানুষকে চোখরাঙানো বা ভয় দেখানোর ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা যাচ্ছে;
- উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে আইনজীবীরা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়েছেন। আদালতের আধিকারিক হিসেবে আইনজীবীদের প্রথম এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো আইনব্যবস্থার অলঙ্ঘনীয়তা রক্ষা করা ও তাকে তুলে ধরা;
- এবং কোনও সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক এজেন্ডার কাছে আইনব্যবস্থাকে খর্ব হতে না দেওয়া।
আই.এ.পি.এল.–এর তরফ থেকে আমরা দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলির সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা এবং আইনের যথাযথ প্রক্রিয়াকে তুলে ধরার পরিবর্তে ন্যায়বিচারের পথে বাধা সৃষ্টিকারী আইনজীবীদের তীব্র নিন্দা করি। আমরা বিশ্বাস করি সমস্ত মানুষের কাছে নির্ভয়ে আদালতে যাওয়ার অধিকার থাকা উচিত। কিন্তু এইসব ঘটনা, যেখানে আইনজীবীরাই ভীতিপ্রদর্শন এবং শারীরিক আক্রমণ করছেন, সাধারণ মানুষের মনে সেই বিশ্বাস জন্মাতে দেয় না। এই ধরনের ঘটনাগুলি প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের নীতিগত প্রয়োগের পথে প্রভাব বিস্তার ও বাধা সৃষ্টি করে।
অতএব, আমাদের দাবী এই যে কাঠুয়া বার এসোসিয়েশনকে তাঁদের নিয়মবহির্ভুত এবং অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে, তদন্তে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে, এবং বিচারব্যবস্থাকে তার মতো করে কাজ করতে দিতে হবে। আমাদের দাবী এই ঘটনার স্বাধীন এবং ন্যায্য তদন্ত ও বিচার।
অ্যাডভোকেট সুধা ভরদ্বাজ (আইএপিএল, সহ–সভাপতি), অ্যাডভোকেট সুরেন্দ্র গ্যাডলিং (আইএপিএল, সেক্রেটারি)।
(লেখাটিতে সমস্ত hyperlink গ্রাউন্ডজিরো–র যোগ করা)