নিজস্ব সংবাদদাতা
অনুগত ভৃত্য না হলে সাংবাদিককে শাসকেরা পছন্দ করে না। সব দেশে সব কালেই তা সত্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার তার ব্যতিক্রম নয়। থাকার কথাও নয়।
মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসতে না বসতে যিনি বিরোধীদলকে মুখে কুলুপ আঁটার হুকুম জারি করেন, তাঁর হাতে যে গণতন্ত্র নিরাপদ থাকতে পারে না এ কথা বুঝতে কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ঠ। আর এই সরকারের এক অনন্য কীর্তি রাষ্ট্রশক্তি, তাঁবেদার ‘বিশিষ্ট’ সাংবাদিক এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় প্রিন্ট ও অডিও ভিস্যুয়াল ‘মিডিয়া চেন’ তৈরি করা। সম্পূর্ণ অনৈতিক ভাবে সরকারি গা-জোয়ারির জেরে রাজ্যের গ্রন্থাগারগুলি সেই সংবাদপত্রগুলিকে নিতে বাধ্য হয়েছিল। সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল অন্যান্য প্রধান দৈনিকগুলিকে। ‘ভালো’ কাজের জন্য সম্পাদকদের কেউ কেউ রাজ্যসভায় মনোনীতও হয়েছিলেন। যদিও সেই ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ সাধারণ মানুষের টাকা লুটের দায়ে আজও শ্রী ঘরে। শ্রীঘরে যেতে হয়েছে এক সম্পাদককেও, তবে ভিন্ন কারণে। তাঁর মুখ বন্ধ করা সরকারের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়েছিল। বাংলার ২০০ বছরের সাংবাদিকতার ইতিহাসে সম্ভবত এ জাতীয় কোনও নজির নেই। যারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে চায়নি, অভিযোগ, তাদের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে, পুরনো বিজ্ঞাপনের টাকা আটকে ‘লাইনে’ আনার চেষ্টা কিছু কম হয়নি। হাতে মার বিগত ৭০ বছরে এ রাজ্যের সাংবাদিকরা কিছু কম খায়নি, কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে এভাবে ভাতে মারার চক্রান্ত এ রাজ্যে কখনও হয়নি।
জেলার সাংবাদিকদের অবস্থা আরও করুণ। শারীরিক নিরাপত্তা জেলা সাংবাদিকদের কোনোদিনই ছিল না, মিডিয়া বিজনেস মডেলে তাদের আর্থিক নিরাপত্তাটুকুও নেই। তবুও, বুক ফুলিয়ে কাজ করার অনেক নিদর্শন তারা রেখেছে এবং অনেকেই রেখে চলেছে। প্রতিনিয়ত ভয় ও হুমকির আবহে কাজ করতে হয় তাদের। উপঢৌকনের প্রলোভন তো রয়েইছে। এক কথায় হয় প্রলোভন না হয় ভয় দেখিয়ে সাংবাদিকদের মেরুদণ্ড ভেঙে দাও। বাম আমলেও ভয় ছিল, হুমকি ছিল। এ আমলে তা সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। বাম আমলে দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবের প্রতিবাদে মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ায় থানা ঘেরাও এবং পুলিশের গুলিচালনার ঘটনা ঘটে। ওই সময় জেলা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংবাদপত্রও সাহস দেখিয়েছে সীমান্তদুষ্কৃতী এবং সব রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশের ধারাবাহিক তদন্তমূলক সংবাদ প্রকাশ করার। আজ যা প্রায় একরকম অসম্ভব।
২০১৮ সালে ‘বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত’ গড়ার ঘোষিত নীতি ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের। অতএব, দলের সশস্ত্র ‘উন্নয়ন বাহিনী’ পথের অধিকার নিল। শুধু কি তাই ব্লক ও কোথাও কোথাও মহকুমা প্রশাসনিক ভবনের দখল নিয়েছে তারা। অবশ্যই পুলিশ-প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে। এই স্বৈরাচারের খবর, ছবি প্রকাশ হয়ে পড়ুক এমনটি কখনও হতে দিতে পারে না শাসক। অতএব, শুধু বিরোধী নেতা, প্রবীণ বিধায়ক, সাংসদ, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে মনোনয়নকারীদের পিটিয়ে হাত-পা-মাথা ভেঙে দিলে চলবে না, সাংবাদিকদের, বিশেষভাবে চিত্র সাংবাদিকদের পেটাতে হবে। কেন না ছবি যে কথা বলে। কথা রেখেছে উত্তর পরিবর্তন ‘পরিবর্ত হার্মাদরা’।
অবশেষে রাস্তায় নামতে বাধ্য হলেন সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিকরা। রাজ্য জুড়ে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপর ধারাবাহিক অত্যাচার চলছিলই। এবার খোদ কলকাতায় এক সাংবাদিককে আলিপুর ট্রেজারি বিল্ডিং থেকে অপহরণ করার অভিযোগ উঠল। এই সেই আলিপুর ট্রেজারি যার সামনে গলায় শাল জড়িয়ে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস যুব নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় তাঁর দাবি ছিল কংগ্রেসে ‘ক্রিমিনাল’দের মনোনয়ন দেওয়া যাবে না। টাইমস অব ইন্ডিয়ার ওই সাংবাদিক বিপ্লব মণ্ডলের আরও অভিযোগ তাকে শুধু অপহরণ করা হয়নি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে মাত্র আধ কিলোমিটার দূরে এক বস্তিতে আটকে রেখে ফের অত্যাচার করা হয়। মোবাইল থেকে জোর করে মুছে দেওয়া হয় সমস্ত ছবি। এমনকি জামা-কাপড়-জুতো জোর করে খুলে নেওয়া হয়। হুমকি দেওয়া হয় শুধু অন্তর্বাস পরা তাঁর ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা বাদে অন্যান্য সাংবাদিকরা তাকে ওই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করে। একইদিনে নিগৃহীত হন ই-টিভি পোর্টালের সাংবাদিক মানস চট্টোপাধ্যায়। গ্রাউন্ডজিরোকে তিনি জানান, মাটিতে ফেলে অকথ্য অত্যাচার চালায় গুন্ডারা। পুলিশ তাকে পরে উদ্ধার করে। মানসের আরও অভিযোগ, উদ্ধারের নামে পুলিশ তাকে ‘ডিটেইন’ করে। এবং থানায় উপস্থিত তৃণমূল বাহিনীকে সন্তুষ্ট করতে মোবাইল থেকে জোর করে সব ছবি মুছে দেয় পুলিশ। ১১ এপ্রিল কলকাতায় সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিকরা প্রতিবাদে মিছিলের আয়োজন করে। মিছিলে উপস্থিত ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের চিত্র সাংবাদিক শুভম দত্ত বলেন, ‘আলিপুরে উন্নয়নপন্থীরা সাংবাদিকদের দু’তিনদিন ধরে হেনস্থা করে চলেছে। দু’জন চিত্র সাংবাদিককে মারধর করেছে। আরও বড় কিছু হতে পারে।’ প্রবীণ চিত্র সাংবাদিক দেবাশিস রায় নিগ্রহকারীদের ‘দুষ্কৃতী’ বলে অভিহিত করেন।
রাজ্য জুড়ে সন্ত্রাস, সাংবাদিক নিগ্রহের অভিযোগ, একদা পরিবর্তনকামী বুদ্ধিজীবীদের একাংশের কঠোর সমালোচনার উত্তরে সন্ত্রাসপর্বে প্রথম মুখ খুলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন ‘কিস্যু হয়নি’। সাংবাদিক নিগ্রহের অভিযোগও অস্বীকার করে তিনি বলেন, “…আলিপুরে এক সাংবাদিককে হেনস্থা করা হয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ, আলিপুরেই আমার বাড়ি। আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বললাম। ওরা বলল ওদের কাছে কোনও খবর নেই। সেই সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জেনেছে কিছুই ঘটেনি।” শুধু অস্বীকার নয়, এমনকি তিনি হুঁশিয়ারি দেন, “মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের চক্রান্তের দায়ে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে সরকার আইনি ব্যবস্থা নেবে।” (এই সময়, ১২ এপ্রিল ২০১৮।)
এর মধ্যে অবশ্য অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। অপ্রিয় প্রশ্নের জবাবে প্রশ্নকারী ছাত্রীকে মাওবাদী বলে অভিযুক্ত করার পর জাতীয় টেলিভিশনের শো ছেড়ে বেরিয়ে আসার রেকর্ড তাঁর রয়েছে। ২০১৭ সালে বামপন্থীদের আইন অমান্য কর্মসূচির দিন কলকাতা ও হাওড়ায় ৪০ জনেরও বেশি সাংবাদিককে চূড়ান্ত নিগ্রহ করে পুলিশ। পুলিশ কমিশনার তদন্তের এবং দোষী পুলিশদের শাস্তির আশ্বাস দিলেও কিস্যু হয়নি। উল্টে এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি এক তরুণ সাংবাদিককে চোখ রাঙিয়ে ধমকে উঠে বলেছিলেন, ‘রাজনীতি করবেন না।’ ২০১৫ সালের বিধাননগর পুরসভা নির্বাচন, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বার বার সাংবাদিকরা নিগৃহীত হয়েছেন। কোনও ঘটনায় কারও বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা অনেক প্রবীণ সাংবাদিককেই জরুরি অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেয়। সাংবাদিক নিগ্রহ, খুন, মালিকের উপর চাপ সৃষ্টি করে একের পর এক স্বাধীনতা প্রিয়, ক্ষমতাবানদের প্রশ্ন করার হিম্মত রাখা সম্পাদকদের সরিয়ে দেওয়া, কোটি কোটি টাকার মামলা করা, ‘ফেক নিউজ’-এর ছুতোয় সাংবাদিকদের সরকারি আক্রিডিটেশন বাতিলের চক্রান্ত — এমন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ সংবাদমাধ্যমের উপর লাগাতার ভাবে চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার, বিজেপি নেতৃত্ব, হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, সরকারের বন্ধু পুঁজিপতি কে নেই এই অভিযানে। যদি অভিযোগ ওঠে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে মোদী ও মমতা সরকার একই মুদ্রার দুই পিঠ, তবে তা বোধহয় সহজ ভাবে আর উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এতো স্রেফ এক ব্যক্তিকে উলঙ্গ করা নয়, এক সাংবাদিককে অপমান করা নয়, সাংবিধানিক অধিকারের অপমান। কার্যত তৃণমূল দল ও সরকারের স্বৈরাচারী রূপটি আর ঢাকাঢাকি দিয়ে রাখা গেল না। উলঙ্গ হয়ে পড়ল।